Table of Contents
Toggleসরকারের সংজ্ঞা Definition of Government
সরকার হলো রাষ্ট্রের মুখপাত্র বিশেষ। যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রকাশিত হয় তাই সরকার। কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে সকল ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে তাদের নিয়ে যে সংস্থা গঠিত হয় তাই সরকার।
রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরকারকে দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। সংকীর্ণ অর্থে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীর সমষ্টিকে সরকার বলে। ব্যাপক অর্থে যাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা পরিচালিত হয় তাদের সমষ্টিকে সরকার বলে।
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে সরকারের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিয়ে সরকারের কতিপয় সংজ্ঞা প্রদান করা হলো :
- অধ্যাপক গার্নার (Prof. Garner) সরকারের সংজ্ঞায় বলেন, “সরকার হলো একটি কার্যনির্বাহী মাধ্যম বা যন্ত্র, যার মাধ্যমে সরকারের সাধারণ নীতি নির্ধারিত হয় এবং যার দ্বারা সাধারণ কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত ও সাধারণ স্বার্থ সাধিত হয়।”
- অধ্যাপক গেটেল (Prof. Gettell) বলেন, “সরকার হলো রাষ্ট্রের একটি সংস্থা বা যন্ত্রবিশেষ।”
উইলোবী (Willoughby) বলেছেন, “সরকার হলো একটি প্রতিষ্ঠান বা যন্ত্র, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার ইচ্ছাকে গঠন ও কার্যকর করে।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল ( Aristotle) এর মতে, “The government of every where the sovereign in the
state and the constitution is infect the government.”
সুতরাং সরকার বলতে বুঝায় রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি নীতিনির্ধারণ ও সর্বোচ্চ ক্ষমতা যার মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত হয়ে থাকে। এক কথায় শাসন, আইন ও বিচার বিভাগে কর্মরত সকলের সমন্বয়ে যে সরকার গঠিত হয় তাই সরকার। সরকারের
মাধ্যমে রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যাবলি প্রকাশিত ও সম্পাদিত হয়ে থাকে।
সরকারের শ্রেণিবিভাগ Classification of Government
সরকারের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কিত আলোচনা কেবল আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বিষয় নয়। কেননা আধুনিককালে যেমন বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সরকারের বিভিন্ন প্রকার ও শ্রেণির উল্লেখ করেছেন, তেমনি প্রাচীনকালেও সরকারের শ্রেণিবিভাগ করা হতো। অধ্যাপক অ্যালান আর, বল ( Allan R. Ball) মন্তব্য করেছেন, “রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রেণিবিভাজন সম্পর্কিত
আলোচনা সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে।”
তিনি আরও বলেন, “শ্রেণিবিভাগের পর্যালোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি কাঠামো এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য সম্পর্কে ধারণা করা যায় এবং প্রতিটি সরকারি কাঠামো সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়।”
অধ্যাপক গার্নার (Prof. Garner) বলেন, সরকারের সংস্থাগুলোর কাঠামো, প্রকৃতি, কার্যপদ্ধতি এবং পারস্পরিক সম্পর্ক সকল রাষ্ট্রে এক রকম নয়। কারণ সকল দেশের সরকার এক রকম হয় না। যে কারণে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সূচনালগ্ন থেকে অতি সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত রাজনৈতিক পর্যালোচনায় সরকারের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কিত আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। সাধারণত সরকারের প্রচলিত শ্রেণিবিভাগসমূহ হলো :
১. সরকারের প্রাচীন শ্রেণিবিভাগ (Ancient Classification of Government); “
২. সরকারের আধুনিক শ্রেণিবিভাগ (Modern Classification of Government);
৩. সরকারের সর্বাধুনিক শ্রেণিবিভাগ (More Modern Classification of Government)।
সরকারের প্রাচীন শ্রেণিবিভাগ Ancient Classification of Government
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় প্লেটো (Plato) ও এরিস্টটলের (Aristotle) শ্রেণিবিভাগকে সরকারের প্রাচীন শ্রেণিবিভাগ বলে। নিম্নে তাঁদের সরকারের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
ক প্লেটোর সরকারের শ্রেণিবিভাগ Plato’s Classification of Goverment
গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডেটাস ( Herodetous) সরকারকে রাজতন্ত্র (Monarchy), ধনিকতন্ত্র (Oligarchy) এবং গণতন্ত্র (Democracy) এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (Plato) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ “দি রিপাবলিক” (The Republic) এ তাঁর নিজস্ব কল্পিত রাজ্যের শাসক তথা সরকার সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি তাঁর সরকারের আলোচনায় “বিশুদ্ধ” (Pure) ও “বিকৃত” (Perverted) এই দুটি নীতি অনুসরণ করেছেন। এ দুটি নীতির ভিত্তিতে তিনি সরকারকে দুইভাগে ভাগ করে আলোচনা করেছেন। যথা :
১. বিশুদ্ধ সরকার ( Pure Government ) : প্লেটোর বিশুদ্ধ প্রকৃতির সরকার হলো এমন এক সরকার যার উদ্দেশ্য সদগুণের বাস্তবায়ন করা। তিনি ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ রাষ্ট্র বাস্তবায়নে শিক্ষা ও সদগুণের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি তাঁর বিশুদ্ধ প্রকৃতির সরকারকে তিনভাগে ভাগ করেছেন। যথা—
ক. রাজতন্ত্র (Monarchy);
খ. অভিজাততন্ত্র (Aristocracy);
গ. স্বাভাবিক গণতন্ত্র ( Moderate Democracy)।
২. বিকৃত সরকার (Perverted Government) : সরকারের বিকৃত রূপ হলো প্লেটো প্রদত্ত বিশুদ্ধ সরকারের বিকৃত রূপ। তিনি এ প্রকৃতির সরকারকে অমঙ্গলকর সরকার বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা এ ধরনের সরকার জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করে না। তারা সর্বদা নিজেদের স্বার্থে ব্যস্ত থাকেন। প্লেটো তাঁর বিকৃত সরকারেরও তিনটি রূপের কথা বলেছেন। যথা-
ক. স্বৈরতন্ত্র বা স্বেচ্ছাচারতন্ত্র (Tyranny);
খ. ধনিকতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্র (Oligarchy);
গ. জনতাতন্ত্ৰ বা লোকতন্ত্র (Mobocracy)।
প্লেটো প্রদত্ত সরকারের শ্রেণিবিভাগকে নিম্নোক্ত ছকের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় :
বিশুদ্ধ সরকার (Pure Government )
রাজতন্ত্র (Monarchy)
অভিজাততন্ত্র (Aristocracy)
স্বাভাবিক গণতন্ত্র (Moderate Democracy)
খ এরিস্টটল প্রদত্ত সরকারের শ্রেণিবিভাগ Aristotle’s Classification of Government
বিকৃত সরকার (Perverted Government) স্বৈরতন্ত্র বা স্বেচ্ছারতন্ত্র (Tyranny )
ধনিকতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্র (Oligarchy)
জনতাতন্ত্র বা লোকতন্ত্র (Mobocracy)
রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে এরিস্টটল ( Aristotle) রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান এবং শাসনতন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম আলোচ্য বিষয় সরকারের শ্রেণিবিন্যাস সম্পর্কে এরিস্টটল প্রণীত ধারণা বেশ পরিপক্ক। তিনি বলেন, কোনো একটি দেশের সরকার পদ্ধতি কীরূপ হবে তা নির্ভর করে সময় ও সে দেশের জনগণের উপর। সরকারের শ্রেণিবিন্যাসকরণে এরিস্টটল তৎকালীন বিশ্বের ১৫৮টি দেশের শাসনতন্ত্র (সংবিধান) পর্যালোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি দুটি স্বতঃসিদ্ধ নীতির ভিত্তিতে সরকারের শ্রেণিবিন্যাস করেছেন। এগুলো হলো :
১. সংখ্যানীতি (Principle of number) (চরম ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারীর সংখ্যা);
২. গুণ/ উদ্দেশ্য (Principle of Quality purpose) (সরকার পরিচালনার উদ্দেশ্য); এটা আবার স্বাভাবিক ও বিকৃত সরকার এই দুই ভাগে বিভক্ত।
এই দুটি নীতির আলোকে তিনি সরকারের শ্রেণিবিভাগ করেছেন। তাঁর মতে, শাসনের ক্ষমতা শুধুমাত্র একজনের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকা উচিত নয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একজন, কয়েকজন এবং বহুজনের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। এ প্রেক্ষাপটে তিনি “একজনের শাসন” (Rule by one), “কয়েকজনের শাসন” (Rule by few) ও “বহুজনের শাসন” (Rule by many)-এর কথা বলেছেন। আবার উদ্দেশ্যের দিক থেকে যে সরকার জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে পরিচালিত হয় সেই সরকারকে তিনি বলেছেন স্বাভাবিক সরকার। অপরদিকে যে সরকার জনকল্যাণের পরিবর্তে কেবলমাত্র শাসকশ্রেণির স্বার্থ অর্জনে কাজ করে তাকে বলেছেন বিকৃত সরকার। নিয়ে ছকের মাধ্যমে সরকারের শ্রেণিবিভাগটি দেখানো হলো :
শাসকের সংখ্যা (Number of Rulers)
একজনের শাসন ( Rule by one) কয়েকজনের শাসন ( Rule by a few )
বহুজনের শাসন ( Rule by many )
এরিস্টটল প্রদত্ত সরকারের শ্রেণিবিভাগ
স্বাভাবিক রূপ
(Normal form)
রাজতন্ত্র (Monarchy) অভিজাততন্ত্র (Aristocracy) মধ্যমতন্ত্র ( Polity )
উদ্দেশ্য
বিকৃত রূপ
(Perverted form)
স্বৈরতন্ত্র (Tyranny) ধনিকতন্ত্র (Oligarchy)
গণতন্ত্র (Democracy)
নিম্নে এরিস্টটলের সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. একজনের সরকার ( Rule by One )
ক. রাজতন্ত্র (Monarchy) : রাজতন্ত্র এরিস্টটল ( Aristotle) প্রদত্ত স্বাভাবিক সরকারের প্রথম রূপ। মহৎ উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হয়ে সরকারের স্বাভাবিক অবস্থায় শাসনক্ষমতা যদি একজনের হাতে ন্যস্ত থাকে তবে তাকে রাজতন্ত্র বলে। অর্থাৎ, রাজতন্ত্রে সার্বভৌম ক্ষমতা পরম্পরায় একজনের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং এতে শাসনক্ষমতা পরিচালিত হয় সমগ্র সমাজের স্বার্থে। তাঁর ভাষায়- “If sovereignty resides in one person, it is monarchy.” এরিস্টটলের মতে, রাজতন্ত্র সর্বোত্তম
শাসনব্যবস্থা যা ধনীকে অন্যায় এবং গরিবকে লোভ থেকে বাঁচায়।
খ. স্বৈরতন্ত্র (Tyranny) : স্বৈরতন্ত্র হলো এরিস্টটল (Aristotle) প্রদত্ত বিকৃত (Perverted) সরকারের প্রথম রূপ। এটি রাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। এ ধরনের সরকার ব্যবস্থায় শাসক জনস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে সচেষ্ট থাকে। অর্থাৎ, যে শাসক ন্যায়নীতি ও আইনের শাসন হতে বিচ্যুত হয়ে জনগণের উপর অত্যাচার, উৎপীড়ন, শোষণ, আগ্রাসন ইত্যাদি চালায় তাকে এরিস্টটল স্বৈরাচারি রাজা বা শাসক বলে অভিহিত করেন এবং এরূপ রাজার শাসনই স্বৈরতন্ত্র। তাঁর ভাষায়, “If sovereignty resides in one person to serve self-interest or benefit of the community, it is
tyranny.’
২. কয়েকজনের সরকার (Rule by Few ) :
ক. অভিজাততন্ত্র (Aristocracy) : এরিস্টটল কয়েকজন শাসক দ্বারা পরিচালিত স্বাভাবিক ধরনের সরকারকে অভিজাততন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব একজনের পরিবর্তে কয়েকজনের হাতে ন্যস্ত থাকে। সুশিক্ষায় শিক্ষিত, ন্যায় ও প্রজ্ঞাবান এবং সকল প্রকার দুর্নীতির ঊর্ধ্বে ওঠে তারা জনস্বার্থে তাদের কর্মকাণ্ড সুচারুরূপে পরিচালনা করে। এধরনের সরকারের উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধন ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা।
খ. ধনিকতন্ত্র (Oligarchy) : অভিজাতন্ত্রের বিকৃত রূপ হলো ধনিকতন্ত্র। এ ব্যবস্থায় কিছু লোক তাদের সম্পদের প্রাচুর্যের বিনিময়ে তাদের হাতে ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত রাখে। সেই সাথে সম্পদের আহরণ ও সংরক্ষণ করে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করে। এ শাসনব্যবস্থায় জনস্বার্থের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়। এরিস্টটলের ভাষায়— “যে সরকার মুষ্টিমেয় ব্যক্তি কর্তৃক পরিচালিত এবং তারা কেবলমাত্র শাসক শ্রেণির স্বার্থে পরিচালিত হয় তাকে ধনিকতন্ত্র বলে।”
৩. বহুজনের সরকার (Rule by Many ) :
ক. মধ্যতন্ত্র (Polity) : যে শাসনব্যবস্থায় বহুজনের হাতে শাসনক্ষমতা ন্যস্ত হয় এবং সমাজ ও জনগণের সার্বিক কল্যাণের লক্ষ্যে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয় তাকে মধ্যতন্ত্র বা ন্যায়তন্ত্র বলে। এরিস্টটলের ভাষায়— “If the sovereign power resides in large portion of the population, it is polity.” তিনি আরও বলেন— “Polity is a compromise between oligarchy and democracy.” তিনি মধ্যতন্ত্রকে সর্বোত্তম সরকার বলে অভিহিত করেছেন।
খ. গণতন্ত্র (Democracy) : আধুনিক যুগে গণতন্ত্রের জয়জয়কার হলেও স্বনামধন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটলের মতে, গণতন্ত্র হলো সর্বনিকৃষ্ট সরকার। তাঁর মতে, মধ্যতন্ত্র বিকৃত হয়ে গণতন্ত্রে পরিণত হয়। এখানে শাসন ক্ষমতা বহুজনের হাতে থাকলেও শাসন পরিচালিত হয় শ্রেণিস্বার্থে। এ ব্যবস্থায় আইনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করে মনগড়াভাবে শাসন পরিচালনা করা হয়। তাঁর ভাষায়— “If the sovereign power resides in the large portion of the population to exercise the power for their self interest it is democracy.”