সরকারের অত্যাধুনিক শ্রেণিবিভাগ

সরকারের আধুনিক শ্রেণিবিন্যাসের সমালোচনার প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিককালে সরকারের আরেক ধরনের শ্রেণিবিন্যাস লক্ষ করা যায় ৷ এর প্রবক্তা হলেন প্রখ্যাত সমাজতত্ত্ববিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার (R. M. MacIver)। তিনি তাঁর সুবিখ্যাত Web of Goverment গ্রন্থে সরকারের এরূপ শ্রেণিবিভাগ উপস্থাপন করেছেন। এতে তিনি সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক, সমষ্টিগত ও সার্বভৌমত্ব এর ভিত্তি ব্যবহার করেছেন। নিম্নের ছকে সরকারের আধুনিক শ্রেণিবিভাগ উল্লেখ করা হলো :

ক. সাংবিধানিক ভিত্তি (Constitutional Basis) : সংবিধান হলো রাষ্ট্রপরিচালনার মৌলিক বিধি-বিধানের সমষ্টি ।

ম্যাকাইভার (MacIver) সংবিধানের আলোকে সরকারকে সাত ভাগে ভাগ করেছেন। যথা :

১. রাজতন্ত্র (Monarchy);

২. স্বৈরতন্ত্র (Tyranny);

৩. ধর্মতন্ত্র বা ঈশ্বরতন্ত্র (Theocracy);

৪. দ্বৈতশাসক প্রধান (Dual Headship Government);

৫. প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র (Direct Democracy);

৬. নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র (Limited Monarchy);

৭. প্রজাতন্ত্র (Republic) ।

খ. অর্থনৈতিক ভিত্তি (Economic Basis) : অর্থনীতি ও রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে কারণে ম্যাকাইভার

অর্থনৈতিক ভিত্তির আলোকে সরকারের শ্রেণিবিভাগ করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর সরকারের শ্রেণিবিভাগ হলো :

১. প্রাচীন সরকার (Primitive Government);

২. সামন্তবাদী সরকার (Feudalistic Govern; it);

৩. পুঁজিবাদী সরকার (Capitalistic Government);

৪. সমাজতান্ত্রিক সরকার (Socialistic Government);

৫. সমাজতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সরকার (Socio Capitalistic Government ) ।

গ. জনসমষ্টিগত ভিত্তি (Population Basis) : জনসমষ্টি হলো রাষ্ট্র ও সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। জনসমষ্টির

ভিত্তিতে ম্যাকাইভার সরকারকে ছয়ভাগে ভাগ করেছেন । যথা :

১. উপজাতীয় সরকার (Tribal Government);

২. নগর রাষ্ট্রীয় সরকার (City-state Government); ৩. দেশীয় সরকার (Country Government);

৪. জাতীয় সরকার ( National Government);

৫. বহুজাতিক সরকার (Multi-national Government); ৬. বিশ্ব সরকার ( World Government ) ।

ঘ. সার্বভৌমত্বের ভিত্তি ( Sovereignty Basis) : সার্বভৌমত্ব হলো রাষ্ট্রের এমন একটি বিশেষ উপাদান যার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র অপরাপর রাষ্ট্র তথা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে মুক্ত থাকে। ম্যাকাইভার অত্যাধুনিক সরকারকে সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে তিনভাগে ভাগ করেছেন। যথা :

১. এককেন্দ্রিক সরকার (Unitary Government);

২. যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার (Federal Government);

৩. সাম্রাজ্যবাদী সরকার (Imperial Government )।

ম্যাকাইভারের অত্যাধুনিক সরকারের শ্রেণিবিভাগ নিম্নের ছকে উপস্থাপন করা সম্ভব :

সাংবিধানিক ভিত্তি

অর্থনৈতিক ভিত্তি

জনসমষ্টিগত ভিত্তি

সার্বভৌমত্বের ভিত্তি

রাজতন্ত্র (Monarchy)

প্রাচীন সরকার

উপজাতীয় সরকার

এককেন্দ্রিক সরকার

(Primitive government)

(Tribal government )

(Unitary Government )

স্বৈরতন্ত্র (Tyranny)

সামন্তবাদী সরকার

নগর রাষ্ট্রীয় সরকার

যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার

(Feudalistic

government

(City-state

(Federal Government)

Government)

ধর্মতন্ত্র বা ঈশ্বরতন্ত্র

পুঁজিবাদী সরকার

দেশীয় সরকার

সাম্রাজ্যবাদী সরকার

(Theocracy)

(Capitalistic

(Country government) | (Imperial

government)

Government)

দ্বৈতশাসক প্রধান

সমাজতান্ত্রিক সরকার

জাতীয় সরকার (National

(Dual Headship

(Socialistic

Government)

Government)

Government)

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র (Direct

সমাজতান্ত্রিক পুঁজিবাদী

বহুজাতিক সরকার

Democracy)

সরকার (Socio-

(Multinational

Capitalistic Government)

Government)

নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র

(Limited Monarchy)

বিশ্ব সরকার (World Government)

প্রজাতন্ত্র (Republic)

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে দেখা যায় যে, ম্যাকাইভার ( MacIver) চারটি বিশেষ নীতির ভিত্তিতে সরকারের শ্রেণিবিভাগ করেছেন। সাম্প্রতিককালে অনেক চিন্তাবিদ ম্যাকাইভারের সরকারের শ্রেণিবিভাগকে যৌক্তিক সরকার বলে আখ্যায়িত করেছেন।

 

সরকারের সর্বাধুনিক শ্রেণিবিভাগ Ultra Modern Classification of Government

বাস্তববাদী কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও গবেষক অতি সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের সর্বাধুনিক শ্রেণিবিভাগ উল্লেখ করেছেন। কারণ তাঁরা সরকারের আধুনিক ও অত্যাধুনিক শ্রেণিবিভাগকে অসম্পূর্ণ, অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক বলে অভিহিত করেছেন। এতে তাঁরা আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান বা কাঠামোগত আনুষ্ঠানিক রূপের মধ্যে সরকারের মূল পরিচয় পাননি।

ফলশ্রুতিতে, আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের সাথে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, অর্থনীতি, সমাজ, মনস্তত্ত্ব, ভূগোল, পরিবেশ প্রভৃতি বিষয় সরকারের রূণ ও প্রকৃতিকে অন্তর্ভুক্ত করে সরকারের শ্রেণিবিভাগ করা হয়। এ মতবাদের অনুসারীদের মধ্যে আছেন ডেভিড ইস্টন, অ্যালান বল, এ্যালমন্ড ও পাওয়েল প্রমুখ সর্বাধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। এরা মূলত রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জোর দেন। অধ্যাপক বল (A. R. Ball)-এর ভাষায়, “A more rewarding approach to the problems of classification would be to classify types of political system rather than to concentrated one types of government.”

অ্যালান বল (A, R. Ball)-এর মতে, রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা :

১. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা (Democratic System) : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হলো একাধিক রাজনৈতিক দলের

কার্যকারিতা, অবাধ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনের চাপসৃষ্টিকারী সংঘ ও সমিতির উপস্থিতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রভৃতি ।

2. সর্বাত্মকবাদী ব্যবস্থা (Totalitarian System) : সর্বাত্মকবাদী ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ব্যক্তি ও সমাজজীবনের সর্বস্তরে সরকারের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ, একটি রাজনৈতিক দলের আইনগত স্বীকৃতি, কোনো একটি আদর্শের ব্যাপক প্রভাব প্রভৃতি । ৩. কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা (Autocratic System) : কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো রাজনৈতিক

ক্রিয়াকলাপ, কোনো প্রভাবশালী আদর্শের অনুপস্থিতি, বলপ্রয়োগের প্রবণতা, কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা সংঘের একচেটিয়া অধিকার । এই তিন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, মূল্যবোধ ও আদর্শের ভিত্তিতেই বিভিন্ন তা নয়, অর্থনৈতিক দিক দিয়েও তারা ভিন্ন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে উন্নত, কিন্তু সর্বাত্মকবাদী ও কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা উন্নয়নশীল ।

এই তিন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে সরকারের রূপও বিভিন্ন হতে পারে। যেমন :

ক. গণতন্ত্র হতে পারে—

১. এককেন্দ্রিক;

২. যুক্তরাষ্ট্রীয়;

৩. সংসদীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত:

৪. রাষ্ট্রপতি শাসিত ।

১. বিশেষ আদর্শবাদী; ২. আদর্শহীন;

৩. সাম্যবাদী;

৪. ফ্যাসিবাদী।

খ. সর্বাত্মকবাদী ব্যবস্থা হতে পারে—

গ. কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা হতে পারে—

১. সনাতনি (সৌদি আরব, নেপাল);

২. আধুনিকতাপ্রবণ (সিরিয়া, ইরাক);

আধুনিকতাপ্রবণ কৰ্তৃত্ববাদী সরকার আবার সামরিক (মিয়ানমার) ও বেসামরিক (ইন্দোনেশিয়া) এই দুই প্রকার হতে পারে।

নিচের চিত্রে সরকারের সর্বাধুনিক শ্রেণিবিভাগ উপস্থাপিত হলো :

সর্বাধুনিক সরকার

গণতান্ত্রিক শাসন

সর্বাত্মকবাদী শাসন

কর্তৃত্ববাদী শাসন

এককেন্দ্রিক

যুক্তরাষ্ট্রীয়

সাম্যবাদী

ফ্যাসীবাদী

সনাতন

আধুনিক

সংসদীয়

রাষ্ট্রপতি

সংসদীয়

রাষ্ট্রপতি

 

সরকারের মার্কসীয় শ্রেণিবিভাগ Marxist’s Classification of Government

মার্কসবাদীদের মতানুসারে, রাষ্ট্র যন্ত্র (Machine) হিসেবে কাজ করে। প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্বধারী শ্রেণির উপর সরকারের প্রকৃতি নির্ভর করে। যে কারণে সরকারের প্রকৃতি রাষ্ট্রের চরিত্রের উপর নির্ভর করে। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে মানব সমাজের ক্রমবিকাশের ধারা এবং অর্থনৈতিক শক্তি বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের সরকারের কথা বলা যায়। মার্কসবাদে সরকারের শ্রেণিবিভাগের ক্ষেত্রে সমাজব্যবস্থার ঐতিহাসিক প্রকৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কারণ মার্কসীয় দর্শন অনুসারে সরকার হলো সমাজব্যবস্থারই প্রতিফলনস্বরূপ। এ সূত্রে মার্কসবাদে চার প্রকার

সরকারের কথা বলা হয়ে থাকে। এগুলো হলো :

ক. দাসভিত্তিক সরকার (Slavery based Government )

খ. সামন্ততান্ত্রিক সরকার (Feaudalist Government )

গ. বুর্জোয়া সরকার (Bourgeoist Government )

ঘ. সমাজতান্ত্রিক সরকার (Socialist Government )

দাসভিত্তিক সরকার সাধারণত রাজ্যতান্ত্রিক হয়। বুর্জোয়া সরকার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এ ধরনের সরকার একনায়কতান্ত্রিক কিংবা গণতান্ত্রিক, এককেন্দ্রিক বা যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত বা সংসদীয় হতে পারে

 

Leave a Reply