সংবিধানের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর ।

সংবিধানের বৈশিষ্ট্য  Features of Constitution                                                           

               সংবিধানের সংজ্ঞাসমূহ বিশ্লেষণ করলে সংবিধানের কতিপয় আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য মূর্ত হয়ে ওঠে। নিম্নে বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে   ধরা হলো :                                                       

               ১. সংবিধান মূলত একটি আইনমূলক ধারণা ;                                                    

               ২. বিধিবদ্ধ আইন ছাড়াও সংবিধান বলতে বহু রীতি-নীতি এবং প্রথাকেও নির্দেশ করা হয়;                                                            

               ৩. সংবিধান দেশের মৌলিক ও সর্বোচ্চ আইন                                                   

               ৪. সংবিধান রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগবিধি নির্ধারণ করে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের মধ্যে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী কে এবং  কীভাবে এই ক্ষমতা ব্যবহৃত হয় সে বিষয়েও সংবিধান নির্দেশ করে;                                                         

               ৫. সংবিধান রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণ করে;                                               

               ৬. সংবিধান সরকারের মূল কাঠামো এবং গঠনব্যবস্থা স্থির করে দেয় :                                                    

               ৭. সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, তাদের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি, সরকারের সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক— সব কিছুই সংবিধানের   দ্বারা স্থির হয় ।                                                

               ৮. সংবিধান সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে;                                                  

               ৯. সংবিধানের মধ্যে রাষ্ট্রচরিত্র প্রতিফলিত হয় ।                                               

               সংবিধানের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা  Importance or Necessity of Constitution                                                            

               সংবিধান পাঠের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হলো :                                                            

               ১. সংবিধানের স্বরূপ উপলব্ধি : সংবিধান অধ্যয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সংবিধানের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারা যায়। যেমন- আমরা মার্কিন সংবিধান অধ্যয়নের মাধ্যমে বুঝতে পারি যে, মার্কিন সংবিধান একাধারে লিখিত, দুষ্পরিবর্তনীয়, প্রেসিডেন্সিয়াল এবং প্রজাতান্ত্রিক। অন্যদিকে ব্রিটিশ সংবিধান অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা বলতে পারি যে, ব্রিটিশ সংবিধান হলো একাধারে অলিখিত, সুপরিবর্তনীয়, সংসদীয় এবং রাজতান্ত্রিক। সংবিধান অধ্যয়নের মাধ্যমে দেশের শাসনব্যবস্থায় সংবিধানের তাৎপর্য ও মর্যাদা উপলব্ধি করা যায়। শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তিতে সংবিধানের চরিত্র ও প্রকৃতি যাই হোক না কেন, সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রয়োজনের স্বার্থেই সংবিধান প্রণীত হওয়া প্রয়োজন ।                                             

               ২. মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা : সংবিধান অধ্যয়নের মাধ্যমে নাগরিকগণ তাদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। ফলে তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। সরকার ব্যক্তির এরূপ কোনো অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে চাইলে সে আদালতের সাহায্য চাইতে পারে। ফলে সরকার সেসব নাগরিক অধিকার লংঘনের সাহস পায় না। আঙবিভাগীয় ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা লাভ : সংবিধান পাঠের মাধ্যমে নাগরিকগণ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে। কোন বিভাগের কি কাজ এবং নাগরিকগণ তাদের কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য কোন বিভাগের দ্বারস্থ হবে তার দিক নির্দেশনা সংবিধানে দেয়া থাকে ।                                                  

               ৪. জাতীয় আদর্শ ও চেতনা লাভ : সংবিধানের জাতির মৌলিক আদর্শ, লক্ষ্য ও ধ্যান-ধারণা স্পষ্টভাবে বর্ণিত থাকে। এসব মূল্যবোধ সংবিধানে এজন্য লিপিবদ্ধ হয় যেন একটি জাতি নিজেকে অন্যান্য জাতি থেকে আলাদা পরিচয়ে চিনতে পারে, যা তাকে দেশের জন্য কাজ করতে অনুপ্রাণিত করবে। ফলে দেখা যায় যে, জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।                                                           

               ৫. সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ : দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা গ্রহণীয় হবে তা সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকে। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন করে সময়োপযোগী সরকার পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। নির্দিষ্ট মেয়াদের পর সরকার কোন ধরনের নির্বাচন পদ্ধতিতে পরিবর্তিত হবে, ভোটাধিকার ব্যবস্থা কেমন হবে, আইনসভার সদস্যদের যোগ্যতা কেমন হবে প্রভৃতি সম্পর্কে সুষ্ঠু দিক- নির্দেশনা সংবিধানে দেয়া থাকে। ফলে ইত্যকার সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ সংবিধানের মাধ্যমেই সম্ভব ।                                                   

               ৬. সংবিধানের মর্যাদা উপলব্ধি : সাধারণ আইনের চেয়ে সাংবিধানিক আইনের যে আলাদা মর্যাদা রয়েছে সংবিধান সংশোধন পদ্ধতির আলোকে তা উপলব্ধি করা যায়। সংবিধানে সাংবিধানিক আইন ও সাধারণ আইনের মধ্যে পার্থক্য করা হয় এবং এই দুই ধরনের আইনের মধ্যে সাংবিধানিক আইন অধিকতর মর্যাদাভুক্ত বলে গণ্য করা হয়। ফলে সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্যবোধের সৃষ্টি হয়।                                                    

               ৭. জরুরি বিধানাবলি : রাষ্ট্র সংকটকালীন সময়ে উপনীত হলে কীভাবে পরিচালিত হবে, যুদ্ধকালীন সময়ে রাষ্ট্রের কর্তব্য কি, কোন আইন বলবৎ থাকবে, নাগরিকদের কী কী অধিকার খর্ব বা রহিত করা হবে, এ সম্পর্কিত একটি দিকনির্দেশনা সংবিধানে দেয়া থাকে। ফলে এ সম্পর্কিত ধারণা সংবিধান পাঠের মাধ্যমে নাগরিকগণ জানতে পারে ।                                                      

               ৮. পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা : দেশের সাথে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্ক কি হবে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শাস্তি, নিরাপত্তা,  সংহতি ও চুক্তি কোন নীতিতে পরিচালিত হবে তার একটি দিকনির্দেশনা সংবিধানে উল্লেখ থাকে ।                                                

               ৯. অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা : দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি নির্ধারণ এবং ভবিষ্যৎ এখতিয়ার কতটুকু হবে সে ব্যাপারে সংবিধানে নির্দেশনা থাকে। শিল্পনীতি, বাণিজ্যনীতি, মালিকানানীতি কী হবে ইত্যাদি অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি ধারণা সংবিধানে উল্লেখ থাকে। দেশ তার প্রয়োজনে কী ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ নাকি মিশ্র অর্থনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে উল্লেখ থাকে। ফলে নাগরিকগণ সংবিধানের মাধ্যমে নিজস্ব অর্থনৈতিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।                                                         

               ১০. আইনশৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা : দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে কী ধরনের বাহিনী গঠন করা হবে, এদের ভূমিকা ও এখতিয়ার কী রকম হবে এবং নাগরিকগণ এক্ষেত্রে কী আচরণ করবে তার একটি নির্দেশনা সংবিধানে উল্লেখ থাকে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কোন কোন বাহিনী নিয়ে গঠিত হবে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ কীভাবে নির্ধারণ হবে, যুদ্ধকালীন সময়ে নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী হবে, সর্বাধিনায়ক কে হবেন, প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রভৃতি নির্দেশনা সংবিধানে দেয়া হয়ে থাকে। ফলে সংবিধান এতদবিষয়ে নাগরিকদের সচেতন হতে সহায়তা করে।                                                    

               ১১. দেশের মৌলিক পরিচয় : প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে তার নিজ দেশের পরিচয় জানা। এমতাবস্থায় সংবিধান এ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয় সীমানার বর্তমান ও ভবিষ্যত নির্ধারণ, জাতীয় সঙ্গীত, পতাকা ও প্রতীক, ধর্মীয় অধিকার, রাষ্ট্রীয় ভাষা, নাগরিকত্ব, জাতীয় স্মৃতি নিদর্শন, জাতীয় সংস্কৃতি প্রভৃতি মৌলিক বিষয় কীরূপ হবে সে সম্পর্কে সংবিধান ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে ।                                                  

               ১২. স্বৈরাচারিতা রোধ : সংবিধান সরকারকে স্বৈরাচারি হতে বাধার সৃষ্টি করে। কেননা, সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ ও মৌলিক                                                      

               আইন হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ফলে সংবিধানের বাইরে গিয়ে সরকারের পক্ষে কোন স্বেচ্ছাচারি আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয় না । উপরিউক্ত ক্ষেত্রসমূহ ব্যতীত আরো কতিপয় বিষয়ে সংবিধানে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে। মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, মানবাধিকার, স্বাস্থ্য, চিন্তা-বিবেক, ভাষা, স্বাধ।তা, জাতীয় জীবনে নাগরিকদের অংশগ্রহণ, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, সুপ্রীম কোর্টের ক্ষমতা, নাগরিকদের সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি বিষয়ে সংবিধানে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। অতএব একটি সর্বসম্মত মৌলিক নীতিমালা তথা সংবিধান প্রণয়নের বিকল্প নেই ।                                                      

Leave a Reply