লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য Written and Unwritten Constitution

লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য Distinction between Written and Unwritten Constitution

লিখিত সংবিধান হলো এমন এক প্রকার সংবিধান যে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় মৌলিক বিধিবিধানসমূহ লিখিতভাবে লিপিবদ্ধ থাকে। আর অলিখিত সংবিধান বলতে এমন এক সংবিধানকে বুঝায়, যে সংবিধানের অধিকাংশ ধারা ও উপধারা অলিখিত থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে কতিপয় পার্থক্য বিদ্যমান। এগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

১. সংজ্ঞাগত পার্থক্য : লিখিত সংবিধান হলো এমন এক প্রকার সংবিধান যে সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় মৌলিক বিধিবিধানসমূহ লিখিতভাবে লিপিবদ্ধ থাকে। অপরদিকে, অলিখিত সংবিধান বলতে এমন এক সংবিধানকে বুঝায়, যে সংবিধানের অধিকাংশ ধারা ও উপধারা অলিখিত থাকে। অলিখিত সংবিধানের অধিকাংশ বিধিবিধান প্রথাগত রীতিনীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে।

২. উৎপত্তিগত/ প্রণয়নগত : লিখিত সংবিধান একটি বিশেষ সংস্থা বা কমিটি কর্তৃক প্রণীত হয়। পক্ষান্তরে অলিখিত সংবিধান প্রণয়নে বিশেষ কোনো সংস্থা বা কমিটির প্রয়োজন হয় না। সমাজব্যবস্থার ক্রমবিবর্তনের সাথে সাথে অলিখিত সংবিধান গড়ে ওঠে। দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অলিখিত সংবিধান গড়ে ওঠে

৩. প্রকৃতিগত প্রকৃতিগত দিক থেকে লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। লিখিত সংবিধানের প্রকৃতি হচ্ছে লিখিত রূপ। অর্থাৎ, লিখিত সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিসমূহ লিপিবদ্ধ থাকে। অপরদিকে, অলিখিত সংবিধানের অধিকাংশ বিধিবিধান অলিখিত অবস্থায় থাকে। এর প্রকৃত উদাহরণ হচ্ছে ব্রিটেনের সংবিধান।

৪. সংশোধন পদ্ধতি : লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে সংশোধনে বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান। লিখিত সংবিধান সহজে পরিবর্তনযোগ্য নয়। আইন পাসের ন্যায় সাধারণ পদ্ধতির মাধ্যমে একে পরিবর্তন করা যায় না। একে সংশোধন করতে হলে বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু অলিখিত সংবিধান সংশোধনে বিশেষ কোনো পদ্ধতির প্রয়োজন পড়ে না। সাধারণ আইন পাসের পদ্ধতি অনুসারে এটি পরিবর্তনযোগ্য।

৫. ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ : লিখিত সংবিধান একটি সুস্পষ্ট সংবিধান। কেননা, এ সংবিধান অনুসারে সরকারের ক্ষমতা বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। কিন্তু অলিখিত সংবিধানে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় না। কারণ এক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা অধিকাংশই অলিখিত থাকে ।

৬. সুস্পষ্টতার পার্থক্য : লিখিত সংবিধান একটি সুস্পষ্ট সংবিধান। এ সংবিধানের অধিকাংশ ধারা-উপধারা কাগজে-কলমে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ থাকে। কিন্তু অলিখিত সংবিধানে তা থাকে না। এ সংবিধানের অনেক বিষয়ের কোনো লিখিত রূপ নেই। এখানে রাষ্ট্রপরিচালনার নীতিগুলো অস্পষ্টভাবে লিখিত থাকে। সুতরাং সুস্পষ্টতার ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে ভিন্নতা বিদ্যমান ।

৭. আইনগত পার্থক্য : লিখিত সংবিধানে আইনের গুরুত্ব বেশি। এক্ষেত্রে সাংবিধানিক আইনই হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন। এ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত নিয়মনীতি সরকার কর্তৃক সৃষ্ট। অলিখিত সংবিধানে আইনগত ভিত্তি কম। কারণ এ ধরনের সংবিধান সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতির মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এটি জনমত ও জনকল্যাণের সাথে সম্পৃক্ত।

৮. বৈপ্লবিক : উভয় সংবিধানে বিপ্লব ও সংস্কারের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। লিখিত সংবিধান জটিল প্রকৃতির। এটি যখন তখন সংশোধন করা যায় না। এরূপ অবস্থায় বিপ্লবের আশঙ্কা দেখা দেয়। পক্ষান্তরে অলিখিত সংবিধানে বিপ্লবের আশঙ্কা কম। কেননা, এটিতে সমাজের প্রয়োজন ও প্রত্যাশা অনুযায়ী সংশোধন আনা যায় । যে কারণে এটি সংস্কারের উপযোগী । ৯. বিচার বিভাগের প্রাধান্যের ক্ষেত্রে : লিখিত সংবিধানে বিচার বিভাগকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এক্ষেত্রে বিচার বিভাগ আইন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত আইনের পর্যালোচনা করে তা বাতিল করতে পারে। কিন্তু অলিখিত সংবিধানে তা সম্ভব নয়। এ সংবিধানের ক্ষেত্রে আইনসভার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয় এবং বিচার বিভাগ দুর্বল হয়। অর্থাৎ, অলিখিত সংবিধানে সাধারণত বিচার বিভাগের প্রাধান্য থাকে না ।

১০. জনমত : লিখিত সংবিধানে জনমত তেমন একটা প্রাধান্য পায় না। কিন্তু অলিখিত সংবিধানে জনমত এবং জনকল্যাণ গুরুত্ব পায় ।

পরিশেষে বলা যায় যে, লিখিত ও অলিখিত সংবিধানের মধ্যে যে পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয় তা মূলত মাত্রা বা পরিমাণগত, মূল্যগত ও প্রকারগত নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো সংবিধানই সম্পূর্ণ লিখিত বা সম্পূর্ণ অলিখিত নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লিখিত হলেও এর কিছু দিক অলিখিত। যেমন— রাষ্ট্রপতির কোনো কোনো ক্ষমতা, দল ও কেবিনেট ব্যবস্থা প্রভৃতি। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের সংবিধান অলিখিত হলেও কিছু লিখিত ধারাও বিদ্যমান। যেমন— সিংহাসনের উত্তরাধিকার, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, পার্লামেন্টের মেয়াদ প্রভৃতি।

Leave a Reply