রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের দোষ

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের দোষ বা অসুবিধাসমূহ

Disqualities or Disadvantages of Presidential Government

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বহুমুখি গুণাবলির পাশাপাশি কিছু দোষ-ত্রুটিও পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে সেসব ত্রুটি আলোচনা

করা হলো :

১. আইন শাসন বিভাগের মধ্যে বিরোধ : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির আলোকে আইন ও শাসন বিভাগকে পৃথক করে দেয়া হয়। এতে করে দুটি বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। ফলশ্রুতিতে আইন প্রণয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে। অধ্যাপক গেটেল (Prof. Gettéll )-এর মতে, “In a presidential Government, there is sometimes non-cooperation between executive and legislative”.

২. অচলাবস্থার সৃষ্টি : আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগির ফলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় এক বিভাগ অপর বিভাগের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়। এতে করে দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

৩. জবাবদিহিতার অভাব : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় সরকার প্রধান তথা রাষ্ট্রপতি কিংবা তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যগণ আইনসভার নিকট দায়ী নন। এমনকি তাঁরা আইনসভার সদস্যও নন। যে কারণে রাষ্ট্রপতি দেশকে বিপথে চালিত করলেও শীঘ্রই তাঁকে নিরস্ত করা সম্ভব নয়। ফলে এ ব্যবস্থায় জবাবদিহিতার অভাব পরিলক্ষিত হয়।

৪. আইন প্রণয়নে নেতৃত্বের অভাব : সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী আইন প্রণয়নে নেতৃত্ব প্রদান করেন। মন্ত্রীরা আইনসভায় খসড়া আইন উত্থাপন করেন, বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান করেন, ভোটাভুটিতে অংশ নেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় আইন প্রণয়নে নেতৃত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয়। কেননা, এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিগণ আইনসভার কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। ফলে আইন প্রণয়নে যেমন নেতৃত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয়, তেমনি সরকারি প্রয়োজনের সময় আইন প্রণয়নে অসুবিধা দেখা দেয় ।

৫. আইন প্রণয়নে দায়িত্বহীনতা : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের আইন প্রণয়নের দায়িত্ব বিভিন্ন কমিটির উপর ন্যস্ত। ফলে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব বিভিন্ন কমিটির মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। কিন্তু প্রয়োজনীয় আইন রচিত হবার পর কমিটি ভেঙে যায়। ফলে প্রণীত আইনের দোষ-ত্রুটির জন্য পরবর্তীকালে কে দায়ী হবে তা নির্দিষ্ট করে নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। ফলে দায়িত্বের অবস্থান নির্ধারণ অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায় ।

৬. অনমনীয় : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি হলো এর অনমনীয়তা। পরিবর্তিত পরিস্থিতির তাগিদে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় কাম্য পরিবর্তন আনয়ন করা সম্ভব হয় না। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বেজহট বলেন, “জনগণ এমন এক সরকারকে পূর্বেই নির্বাচন করেন, যে সরকারের নীতি ও কাজ, আচার-আচরণ তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে খাপ খেতে পারুক বা না পারুক, আইনত তাকে তা করতে হয়।” ফলে এরূপ পরিস্থিতিতে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতির আশংকা থাকে ।

৭. বিচার বিভাগের প্রাধান্য : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের অত্যধিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কেননা, ক্ষমতা বিভাজনের ভিত্তিতে এ ধরনের শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি হলেও বিভিন্ন বিভাগের কার্যের পরিধি ব্যাখ্যা এবং কার্যাবলির বৈধতা বিচারের ক্ষমতা বিচার বিভাগের উপর ন্যস্ত করা হয়। এতে করে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা। মার্কিন উচ্চ আদালতের এ ভূমিকা প্রসঙ্গে

 

৮. বিচারপতি হিউজেস (Hughes) বলেন, “We are living under a constitution, but the constitution is what the judges say ” কিন্তু বিচারকগণ যেহেতু জনপ্রতিনিধি নন, সেহেতু এ ধরনের ক্ষমতা চর্চা করতে গিয়ে প্রায়ই রক্ষণশীলতার পরিচয় প্রদান করেন।

ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের কুফল : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণের ফলে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে অসহযোগিতার উদ্ভব হতে পারে। আর এরূপ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি জনকল্যাণ উপযোগী আইন প্রণয়নেও অনেক সময় ব্যর্থ হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গে অধ্যাপক লাঙ্কি বলেন, “কংগ্রেসের সীমিত ইচ্ছার ফলে রাষ্ট্রপতি সর্বদা ছাড়পত্রবিহীন নাবিকের মতো যথেচ্ছা সমুদ্রে ঘুরে বেড়ান । “

৯. ভারসাম্য নীতির দোষে দুষ্ট : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থায় সাধারণত ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগ করা হয় বিধায় ক্ষমতার ভারসাম্য নীতির (Principle of check and balance) প্রয়োগও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু ভারসাম্য নীতির প্রয়োগের ফলে শাসন, আইন ও বিচারকার্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। অধ্যাপক বিয়ার্ড (Prof. Beard) যথার্থই বলেছেন, “ভারসাম্য নীতি যদিও সহযোগিতা বিধানের জন্য উদ্ভাবিত, তথাপি রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা ক্ষমতা পৃথকীকরণের কুফলকে দূর করা অপেক্ষা আরও প্রকট করে তোলে।”

১০. শাসন বিভাগীয় উদ্যোগহীনতা : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি হলো আইনসভায় আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে শাসন বিভাগের উদ্যোগের অনুপস্থিতি। ফলে শাসন বিভাগ যখন জনগণের কল্যাণে বা শাসনব্যবস্থায় নিজস্ব প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আইন বিভাগ তখন সেই প্রয়োজনীয় আইন সরবরাহের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জাতির জরুরি অবস্থায় শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের মধ্যে এরূপ অসহযোগিতামূলক মনোভাব সৃষ্টি হলে সমগ্র জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ।

১১. স্বৈরাচারী হওয়ার আশঙ্কা : এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি তাঁর কার্যের জন্য কারো নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। এমনকি, রাষ্ট্রপতি তাঁর আজ্ঞাবহ মন্ত্রিসভাকেও কারণে-অকারণে ভেঙে দিতে পারেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রপতি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে নিজ ইচ্ছেমতো তা ব্যবহার করতে পারেন। উপরন্তু নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে অপসারণ করাও কঠিন ও জটিল ব্যাপার। আর এ ধরনের সীমাহীন ক্ষমতা চর্চার সুযোগে রাষ্ট্রপতি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারেন । ১২. বিপ্লবের আশংকা : যেহেতু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিই হলেন সর্বেসর্বা, আইন বিভাগ তাকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণও করতে পারে না। ফলে তিনি সহজেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারেন। আর এই সুযোগে স্বৈরাচার পতনের লক্ষ্যে গণবিপ্লব সৃষ্টি হয়ে অরাজকতার উদ্ভব হতে পারে।

১৩. জাতীয় স্বার্থের অবহেলা : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে। কারণ রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে আইন প্রণয়ন হয়। এসব কমিটি প্রায় ক্ষেত্রেই স্থানীয় বা আঞ্চলিক প্রাধান্য দিতে গিয়ে জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা বা অবহেলা করে।

১৪. আঞ্চলিকতা সৃষ্টি হতে পারে : রাষ্ট্রপতি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হওয়ায় তিনি নিজের এলাকার উন্নয়নের জন্য গুরুত্ব দিতে পারেন । এর ফলে রাষ্ট্রে আঞ্চলিকতা সৃষ্টি হতে পারে। আর এমনতর আঞ্চলিকতা রাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে পারে । এক্ষেত্রে যুক্ত পাকিস্তানের কথা বলা যায়, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছিল।

১৫. স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাব : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বহু কমিটি ও কমিশনের মাধ্যমে সরকারি কার্য পরিচালিত হয় ৷ ফলে তাদের নীতি ও কাজের সমন্বয়ের ক্ষেত্রে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। ফলে এসব কমিটি ও কমিশন বিভিন্ন স্বার্থ গোষ্ঠীর প্রভাবের ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়।

১৬. জনমতের বিরোধী : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় জনমতের সুষ্ঠু প্রতিফলন দেখা যায় না। কেননা, রাষ্ট্রপতি বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও আইনসভায় বাণী প্রেরণের মাধ্যমে জনগণের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারলেও জনগণের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেন না। এর ফলে সরকার ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় ।

১৭. জরুরি অবস্থার অনুপযোগী : কোনো ব্যক্তি একবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারলে তাকে সহজে অপসারণ করা যায় না। ফলে অযোগ্য কোনো ব্যক্তি কায়দা-কৌশলের মাধ্যমে একবার নির্বাচিত হতে পারলে তাকে জরুরি ভিত্তিতে গদিচ্যুত করা সম্ভব নয়। কারণ রাষ্ট্রপতিকে গদিচ্যুত করার জন্য যে বিধান অবলম্বন করতে হয় তা জরুরি অবস্থায় প্রয়োগ উপযোগী নয়। ১৮. সংঘর্ষের আশঙ্কা : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে সহযোগিতার অভাব লক্ষ করা যায় বিধায় এই দুই বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। লাস্কির ভাষায়, “When legislature and executive are of different part, there is constant danger of deadlock”.

পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় দোষ ও গুণ উভয়ই বিদ্যমান। তবে শাসনব্যবস্থা হিসেবে বাস্তবে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা অনেক সফল ও ফলপ্রসূ। স্থায়িত্ব, দক্ষতা ও জাতীয় দুর্দিনে শক্ত হাতে নেতৃত্ব প্রদানে এ শাসনব্যবস্থা অনেকটাই কার্যকর। বর্তমানে শাসন ও আইন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধিতে এ ধরনের শাসনব্যবস্থা কিছু ত্রুটিমুক্ত হচ্ছে।

Leave a Reply