রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের গুণাবলি বা সুবিধাসমূহ Merits or Advantages of Presidential Government
রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে যেসকল ইতিবাচক দিক রয়েছে সেগুলো এধরনের সরকার ব্যবস্থার গুণাবলি হিসেবে চিহ্নিত। এসব গুণ বা সুবিধা অনেকক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বিশেষ বিশেষ গুণাবলি নিম্নে তুলে ধরা হলো :
১ . স্থায়িত্ব বিধান : রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় সরকারের স্থায়িত্ব রক্ষা করা সহজ হয়। কেননা, এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত হন এবং সেই নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতিকে বিনা কারণে অপসারণ করা যায় না। যে কারণে এধরনের সরকার স্থায়ী হয়। আর এ স্থায়িত্বের জন্য সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। ফলে সার্বিকভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত হয়।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ : এ ধরনের সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের সুফল পাওয়া যায়। আইন ও শাসন বিভাগ নিজ নিজ গণ্ডির মধ্যে থেকে স্বীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে বিধায় এক বিভাগ অপর কোনো বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। ফলে শাসন বিভাগ আইন বিভাগের প্রভাবমুক্ত হয়ে এবং বিচার বিভাগ শাসন বিভাগের প্রভাবমুক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারে। এতে করে শাসন প্রক্রিয়া সুন্দর ও সুস্থভাবে পরিচালিত হয়।
৩. ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ : এধরনের সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ ঘটায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ যৌথভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ফলে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা হয় । ৪. ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির কার্যকারিতা থাকায় ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব। কারণ এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি আইন ও বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে কাজ করতে পারেন। আবার বিপরীতে আইন ও বিচার বিভাগ রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকেও কাজ করতে পারে। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হয় ।
৫. জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ : এ ধরনের সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি যুদ্ধ, জাতীয় সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা জরুরি অবস্থায় এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। শাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি কারো নিকট দায়ী নন। যে কারণে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কারো সাথে আলোচনা নাও করতে পারেন। আর আপদকালীন সময়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ দেশের জন্য অনেক উপকার বয়ে আনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ড. গার্নার (Dr. Garner)-, “During war and emergency he can take a number of decisions independently because real power of the government are in the hands of the President.”
৬. শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি : রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ তার দায়িত্ব সম্পাদনের ক্ষেত্রে আইনসভার নিকট দায়ী না থাকায় শাসন বিভাগের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এতে শাসন বিভাগের যোগ্যতা ও নিপুণতার প্রসার ঘটে।
৭. আইনসভার দক্ষতা বৃদ্ধি : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় আইনসভার দক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। কারণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের ফলে আইন বিভাগ শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে কাজ করে। ফলে আইনসভার দক্ষতা বৃদ্ধি পায় ।
৮. দলীয় মনোভাবের প্রতিফলন কম : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলের ক্রিয়াকলাপ সাধারণত কম থাকে। আইনসভার অভ্যন্তরে বিভিন্ন বিল পাসের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে মতদ্বৈততার সৃষ্টি হয় তা সরকারের পক্ষে আস্থা কিংবা বিপক্ষে অনাস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। যদিও মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারব্যবস্থায় এটি সরকারের জন্য একটি হুমকি ।
৯. নামমাত্র শাসকের অনুপস্থিতি : এ ধরনের সরকার ব্যবস্থায় কোনো প্রকার নামমাত্র শাসক প্রধান থাকেন না। রাষ্ট্রপতি সর্বময় কর্তা। নামমাত্র শাসক না হয়ে রাষ্ট্রপতি প্রকৃত শাসক বা প্রধান নির্বাহী হওয়ায় তিনি শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন।
১০. মন্ত্রিদের যোগ্যতা : রাষ্ট্রপতি আইন পরিষদের সাথে আলোচনা ব্যতীত মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগদান করতে পারেন। আর এক্ষেত্রে তিনি এককভাবে যোগ্য ব্যক্তিকে মন্ত্রি হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন বিধায় মন্ত্রিদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। যে কারণে অনেকে মনে করেন যে, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে যোগা মঞ্জী নিয়োগ সম্ভব হয়। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে এ নিয়ম পরিদৃষ্ট হয়।
১১. দলীয় প্রভাব হ্রাস : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় আইনসভার অভ্যন্তরে এবং শাসনব্যবস্থার অন্যত্র দলীয় প্রভাব কম থাকায় দলীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে শাসনকার্য সুন্দর, সুস্থভাবে পরিচালনা করা যায়।
১২. বহুদলীয় ব্যবস্থার প্রয়োগ : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকতে পারে। বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল এককভাবে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন নাও করতে পারে। এরূপ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা কার্যকরী হয়। অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski)-এর মতে, “Multy party system is the more satisfactory and more it is able to express itself through the antithesis of two great parties.”
১৩. জ্ঞানী’ও যোগ্য ব্যক্তির শাসন : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থায় দলমত নির্বিশেষে দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদেরকে প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেয়া যায়। ফলে শাসনকার্যে গতিশীলতা আসে, প্রশাসনের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায় ।
১৪. দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পায়। কারণ এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কার্যের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ফলে বিভাগগুলো নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকে। অধ্যাপক গিলক্রিস্ট (Prof. Gilchrist)-এর ভাষায়, “In presidential government secretaries pay full attention to the administration which creates efficiency in the administration.”
১৫. শাসনকার্যের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় সরকারের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়। কারণ রাষ্ট্রপতি দক্ষ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ লোকদের তাঁর কেবিনেটে নিয়োগ করতে পারেন। আর এ সকল লোকের উপস্থিতি তাঁর কেবিনেটের উৎকর্ষতা বাড়ায় ।
১৬. দলীয় সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির উপর দলীয় সদস্যদের প্রভাব কম থাকে। একবার নির্বাচিত হতে পারলে রাষ্ট্রপতি পদমর্যাদা, বিশেষ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে নিজ দলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ফলে শাসনকার্যে রাষ্ট্রপতিকে তেমন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় না ।
১৭. রাষ্ট্রপতির স্বৈরাচার রোধ : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন এবং সরাসরি জনগণের নিকট দায়ী থাকেন। যে কারণে তিনি জনমত হারানোর ভয়ে গণবিরোধী কাজ-কর্ম হতে বিরত থাকেন। তা না হলে তিনি গণআন্দোলনের কবলে পতিত হবেন। এভাবে রাষ্ট্রপতির স্বৈরাচার রোধ করা সম্ভব হয়।
১৮. বিপ্লব ও গণআন্দোলনের সম্ভাবনা কম : রাষ্ট্রপতি সরাসরি জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন বিধায় জনগণের সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। উপরন্তু তিনি তাঁর নীতি ও কার্যক্রমের জন্য জনগণের নিকট দায়ী থাকেন। যে কারণে তিনি গণবিরোধী কাজ করতে পারেন না। আর অনুরূপ গণবিরোধী কাজে-কর্মে লিপ্ত হলে তাকে অভিসংশনের মাধ্যমে অপসারিত করা যায়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সন অভিসংশনের ভয়ে পদত্যাগ করেন ।
১৯. দেশের উন্নয়ন সম্ভব : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব। কেননা, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য দক্ষ ও যোগ্য লোক নিয়োগ দিতে পারেন। যাদের সহায়তায় তিনি দেশের দ্রুত উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হন।
২০. দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি হ্রাস : রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় দলীয় ও আইনসভার সদস্যদের প্রভাব কম থাকে বিধায় দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি হ্রাস পায়। রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক দল, আইনসভার সদস্য প্রভৃতির সন্তুষ্টির জন্য স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিতে হয় না বিধায় দুর্নীতিও কমে যায়।
২১. উন্নতমানের আইন প্রণয়নে সহায়ক : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থায় শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে আইন পরিষদের তেমন ভূমিকা থাকে না বিধায় আইনসভার সদস্যগণ মনোযোগ সহকারে আইন প্রণয়নে মনোনিবেশ করতে পারেন। ফলে আইনসভা দেশের প্রয়োজনে উপযুক্ত ও উন্নতমানের আইন প্রণয়ন করার সুযোগ ও সুবিধা লাভ করে।
২২. অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের উপযোগী। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার কমবেশি স্থায়ী ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অগ্রগতি অর্জনের জন্য একদিকে সরকারের স্থিতিশীলতা এবং অন্যদিকে দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার মোটামুটি এ দু’টি সুবিধা প্রদানে সক্ষম বিধায় এটি অনুন্নত উন্নয়নশীপ রাষ্ট্রের জন্য উপযোগী ।
উপরিউক্ত বিষয়গুলো রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের গুণ বা উত্তম দিক, যেগুলো ঐ সরকারের সুনাম ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে। যে কারণে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা অনন্য গুরুত্বের দাবিদার। এসব গুণের প্রেক্ষিতে বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশেই রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রচলন রয়েছে।