রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বৈশিষ্ট্য

রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বৈশিষ্ট্য Characteristics of Presidential Government

অপরাপর সরকার ব্যবস্থার ন্যায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায়ও কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা স্বকীয়তা বিদ্যমান। নিম্নে এসব – বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. অভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান সরকার প্রধান : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় একই ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তিনিই হলেন প্রকৃত নির্বাহী প্রধান। এখানে নামসর্বস্ব প্রধানের কোনো অস্তিত্ব নেই। রাষ্ট্রপতিই তত্ত্বগত ও বাস্তবে প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেন, “In a presidential government, the president is the head of the state as well as of the government.”

  1. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ : রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ ঘটে থাকে। কেননা,এ ব্যবস্থায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে কোনো প্রকার সম্পর্ক থাকে না এবং একে অপরের নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি আইনসভাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। আবার আইনসভাও রাষ্ট্রপতিকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এতে ক্ষমতার ভারসাম্য নীতি অনুসৃত হয়। গার্নার (Dr. Garner) বলেন, “In this system the executive and legislature are separate from each others and they have equal status”.

৩. জননির্বাচিত রাষ্ট্রপতি : রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট নির্বাচিত হয় । আইনসভার আস্থা-অনাস্থার উপর রাষ্ট্রপতির স্থায়িত্ব নির্ভর করে না। রাষ্ট্রপতি মূলত জনগণের নিকট দায়িত্বশীল থাকে । ৪. রাষ্ট্রপতির কার্যকাল ও পদচ্যুতি : রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির নির্দিষ্ট কার্যকাল থাকে। রাষ্ট্রপতি সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন। কার্যকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতিকে সাধারণত পদচ্যুত করা যায় না। কেবলমাত্র সংবিধান লঙ্ঘন বা অসদাচরণের দায়ে অথবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে পদচ্যুত করা যায়।

৫. রাষ্ট্রপতি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের রাষ্ট্রপতিই হচ্ছেন প্রকৃত রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান। যে কারণে তিনি হলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। অর্থাৎ, তাঁকে কেন্দ্র করেই প্রশাসন যন্ত্র পরিচালিত হয়। এতে কোনো প্রকার উপাধি বা নামসর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকার প্রধান থাকেন না ।

৬. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার উৎস দায়বদ্ধতা : রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির সকল ক্ষমতার উৎস হলো সংবিধান । অর্থাৎ, সংবিধানই রাষ্ট্রপতিকে প্রভূত ক্ষমতা দিয়েছে। তিনি তাঁর কাজের জন্য জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকেন ।

৭. আজ্ঞাবহ মন্ত্রিসভা : এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে সহায়তা করার জন্য একটি মন্ত্রিসভা থাকে। এই মন্ত্রিসভা রাষ্ট্রপতির অধীন, আজ্ঞাবহ ও এজেন্ট মাত্র। মন্ত্রিসভা মূলত রাষ্ট্রপতির পরামর্শদাতা সংস্থা হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রপতি আইন পরিষদের বাইরে কিংবা ভেতর থেকে তাঁর ইচ্ছেমতো যে কাউকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন ও বরখাস্ত করতে পারেন। সার্বিক কাজের জন্য মন্ত্রিসভার সদস্যরা রাষ্ট্রপতির কাছে দায়ী থাকেন ।

৮. লিখিত দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের সংবিধান সাধারণত লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় প্রকৃতির হয়ে থাকে। এরূপ সংবিধানে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা যেমন লিখিতভাবে বণ্টন করা হয়ে থাকে, তেমনি আবার সংবিধানের কোনো ধারা কিংবা উপধারা পরিবর্তন বা সংশোধন করতে হলে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। যেমন– মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি প্রচলিত এবং সেখানকার সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয়।

*. সংবিধানের প্রাধান্য। রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় সকল ক্ষমতার উৎস হলো সংবিধান। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ভিত্তিতে গরুল ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। ড. গার্নার ( Dr. Garner)-এর মতে, “In a presidential government, the president enjoys real powers of the administration and he exercises all those power under the constitution and the law. “

১০. দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইন পরিষদ : রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় সাধারণত দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইন পরিষদ বিদ্যমান থাকে। রাষ্ট্রপতির নীতি ও সিদ্ধান্তের ভালো-মন্দ যাচাইয়ের জন্য দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইন রगদের প্রয়োজন হয়। অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি আইন পরিষদের নিম্ন কক্ষ ভেঙে দিতে পারেন।

১১. আইনসভার প্রভাবমুক্তা : রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি আইনসভার প্রভাব থেকে মুক্ত। অর্থাৎ, রাষ্ট্রপতির কাজের জন্য আইনসভার কাছে জবাদিহি করতে হয় না এবং তিনি আইনসভার নিকট দায়ীও নন। অর্থাৎ, তিনি সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থাকেন।

১২. রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিগণ আইনসভার সদস্য নন : রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ আইনসভার সদস্য নন। রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীগণ তাদের কাজের জন্য আইনসভাব নিকট দায়ীও নন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি তাঁর কাজের জন্য জনগণের নিকট এবং মন্ত্রীগণ তাঁদের কাজের জন্য রাষ্ট্রপতির নিন্য দায়ী থাকেন।

১৩. সংখ্যাগরিষ্ঠতা গৌণ : রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় আইনসভায় কোনো রাজনৈতিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অপরিহার্য নয়। এক্ষেত্রে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও আইন পরিষদের নির্বাচন পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক দল আইন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে নাও পারে। যেমন— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কখনো কখনো রিপাবলিকান দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও উচ্চ কক্ষের সিনেটে ডেমোক্র্যাট দল সংখ্যাগতিা পায়। আবার কখনো কখনো এর বিপরীত অবস্থাও হয়ে থাকে ।

১৪. বিচার বিভাগের প্রাধান্য : রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় বিচার বিভাগের প্রাধান্যও পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা যায়, যেখানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বিচার বিভাগের প্রাধান্য বিস্তারে সহায়তা দান করেছে। এ ব্যবস্থায় বিচার বিভাগকে সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে স্বতন্ত্র মর্যাদা দেওয়া হয়। ফলে বিচার বিভাগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে।

১৫. সরকারের স্থিতিশীলতা : রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি জনগণের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন এবং নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন। অভিশংসন এস্তাব ব্যতীত আইনসভা রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেন না। ফলে সরকার অনমনীয় ও স্থিতিশীল হয়। অধ্যাপক গিলক্রিস্ট (Gilchrist)-এর ভাষায়, “In the presidential system the president is elected for a fixed tenure and he cannot be removed from his office, before the expire of his time, so it is stable. “

১৬. রাষ্ট্রপতির ভেটো ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় টিকে থাকা আইনসভার আস্থা ভোটের উপর নির্ভর করে না। অথবা তিনি তাঁর নীতি বা কাজের জন্য আইনসভার কাছে দায়ীও নন। তবে রাষ্ট্রপতি আইনসভার গৃহীত বিলে ‘ভেটো দানের’ ‘বিল নাকচ করার ক্ষমতা ভোগ করতে পারেন।

উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের মৌলিক দিক। এগুলো দ্বারাই এ সরকারের মূল পরিচয় ফুটে । এগুলোকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারকে অনুধাবন করা যায় না। এসব বৈশিষ্ট্য বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। এসব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার অন্যান্য সরকার থেকে ভিন্ন।

Leave a Reply