আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা আলোচনা কর। Discuss the role of political party in modern democratic state.
গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা বা গুরুত্ব Role or Importance of Political Party in Democracy
তত্ত্বগতভাবে গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণ কর্তৃক পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। কিন্তু বাস্তবে বর্তমান কালের বিশাল আয়তন রাষ্ট্রগুলোর বিপুল জনগোষ্ঠীর পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাই জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে। আধুনিক গণতন্ত্র হলো পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র। আর প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের মূলভিত্তিই হলো রাজনৈতিক দল। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে কার্যত রাজনৈতিক দলই সরকার পরিচালনা করে। এ কারণে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে দলীয় ব্যবস্থা সর্বজনীন স্বীকৃতি অর্জন করেছে। গণতান্ত্রিক সরকার ও রাজনৈতিক দল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নিম্নে গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব বা ভূমিকা আলোচনা করা হলো
১. জনমত গঠন : প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মূলত জনমত দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল জনমত গঠনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সভা-সমিতি, পত্র- পত্রিকা, বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নীতি ও কর্মসূচির সমর্থনে জনমত গঠন করে। রাজনৈতিক দলও এ ধরনের প্রচারণার সময় জনসেবার আগ্রহই শুধু প্রকাশ করে। লাওয়েল (Lowell)-এর মতে, “জনমতকে সকলের সামনে উপস্থাপন করে জনগণের রায় গ্রহণের উপর্যুক্ত কর্মসূচি প্রণয়ন করা রাজনৈতিক দলের অন্যতম লক্ষ্য।” (Their essential function and the true reason for their existence is bringing public opinion to focus and framing issues for the popular verdict.)
২. জনগণের প্রতিনিধিত্ব : গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসনব্যবস্থা। বাস্তবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিগণই শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাই গণতন্ত্রে দলীয় ব্যবস্থা অপরিহার্য। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে দলীয় শাসন বলা হয়। রাজনৈতিক দলের কোনো সদস্য আইনসভায় নির্বাচিত হলে নিজ এলাকার সমস্যাবলি আইনসভায় তুলে ধরে এবং সেগুলো সমাধানের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। সরকার দলীয় সদস্য সরকারের কাছে নিজ এলাকার সমস্যাবলি ভুলে ধরে এবং সেগুলো সমাধানের চেষ্টা চালায়।
৩. সরকার গঠন ও পরিচালনা। গণতন্ত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো নিজ দলের প্রার্থীদের স্বপক্ষে প্রচারকার্য চালায়। নির্বাচন শেষে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলই সরকার গঠন করে। গণতান্ত্রিক সরকার হলো একটি দলীয় সরকার। সরকার গঠনের পর রাজনৈতিক দল শাসনকার্য পরিচালনায় ভূমিকা পালন করে। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করে দৈনন্দিন শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে।
৪. সরকার পরিবর্তন : গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়ে থাকে। এতে শান্তিপূর্ণ উপায়ে এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করা যায়। সরকার পরিবর্তনের জন্য বিপ্লব বা কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির প্রয়োজন হয় না। শুধু পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। নির্বাচনে জয়লাভ করলে বিরোধী দল সরকার গঠনের সুযোগ পায়। এভাবে গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং শাস্তিপূর্ণ উপায়ে সরকার পরিবর্তন করা যায়।
৫. রাজনৈতিক শিক্ষাদান : গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষা দান করে। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে রাজনৈতিক বিষয়াদি এবং বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করে। এর ফলে জনগণ বিভিন্ন দলের নীতি ও কর্মসূচি এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। তাছাড়া বিরোধী দল সরকারের নীতি ও কর্মসূচি সম্পর্কে দোষ- ত্রুটি তুলে ধরে। জনগণ এসব আলোচনা ও সমালোচনা শুনে রাজনৈতিক শিক্ষা লাভ করে। ফলে জনগণ রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন ও সজাগ হয়ে ওঠে।
৬. জনগণ ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধন : গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল জনগণ ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে। রাজনৈতিক দল থেকে নির্বাচিত আইনসভার সদস্যগণ তাদের অঞ্চলের জনগণের দাবি-দাওয়া ও সমস্যাবলির কথা সরকারকে জানায় এবং সরকার সেগুলো সমাধানে সচেষ্ট হয়। তাছাড়া, রাজনৈতিক দল জনগণকে সরকারের নীতি ও কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত করে। সরকারি দল ও বিরোধী দলের বক্তব্য শুনে জনগণ উভয়ের নীতি ও কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে পারে।
৭.. সরকারের স্বৈরাচারিতা রোধ : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারি দল ও বিরোধী দলের অস্তিত্ব থাকে। বিরোধী দল সরকারের কার্যক্রম ও সিদ্ধান্তের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে। তাই বিরোধী দলের সমালোচনার ভয়ে সরকার স্বৈরাচারী আচরণ করতে পারে না। বিরোধী দল সরকারের নীতি ও কর্মসূচির সমালোচনার মাধ্যমে জনমতকে তাদের সপক্ষে আনার চেষ্টা করে। অধ্যাপক লাস্কি (Laski) বলেছেন, “দেশে স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতার রক্ষাকবচ হলো রাজনৈতিক দল।” তাছাড়া গণতন্ত্রে বিরোধী দলকে বিকল্প সরকার নামে অভিহিত করা হয়।
৮. গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় রাখে : রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক সরকারের স্বরূপ বজায় রাখে। গণতন্ত্রের সফলতার জন্য একাধিক রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হলো দলীয় ব্যবস্থা। আর রাজনৈতিক দলগুলো হচ্ছে তার প্রাণ। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) মন্তব্য করেছেন যে, “রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য এবং প্রত্যেক বৃহৎ, স্বাধীন রাষ্ট্রেই তাদের অস্তিত্ব বিরাজমান।” অধ্যাপক ম্যাকাইভার (MacIver) বলেছেন, “Although party is often extra-constitutional, it is an essential organ of large scale democracy.”
৯. শাসনব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল ও স্থিতিশীল করে : রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ঐক্য, শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা আনয়ন করে। বিশৃঙ্খল জাতি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়কে সুশৃঙ্খল করে তোলে। এটি অনৈক্যের মধ্যে সংহতি আনে, সরকারি দল ও বিরোধী দল জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে ঐক্যবোধ জাগ্রত করে। তাছাড়া সরকারি দল জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করে। ফলে শাসনব্যবস্থা স্থিতিশীল হয় ।
১০. সমস্যা নির্বাচন ও সমাধান : জনগণের পক্ষে কোন সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান আবশ্যক তা অনুধাবন করা সম্ভব হয় না। সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলোই সমস্যা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো জনগণের কাছে উপস্থাপন করে। সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দল কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। রাজনৈতিক দল থেকে নির্বাচিত আইনসভার সদস্যগণ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
১১. স্বার্থের সমষ্টিবদ্ধকরণ ও গ্রস্থিকরণ : রাজনৈতিক দলগুলো বহুমুখি স্বার্থের সমষ্টিবদ্ধকরণে ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক দলই বিভিন্ন গোষ্ঠীর স্বার্থ ও দাবি-দাওয়া একত্রিত করে সরকারের কাছে তুলে ধরে, বিভিন্ন স্বার্থের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নিজের সমর্থনের ভিত্তিকে মজবুত করে। অ্যালমন্ড ও পাওয়েল (Almond and Powell)-এর মতে, “বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীসমূহের দাবি-দাওয়াগুলোকে কার্যপদ্ধতিতে রূপান্তরিত করাই হলো স্বার্থের গ্রস্থিকরণ।” ওয়াসবি (Wasby) বলেছেন, “Parties articulate interest in some cases repeating those of interest groups and in other cases stating new and independent ones.”
১২. রাজনৈতিক অংশগ্রহণ : রাজনৈতিক দল জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করে। দলগুলো জনগণের সামনে বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে। রাজনৈতিক দল জাতীয় ও আঞ্চলিক নির্বাচনে জনগণকে সম্পৃক্ত করে অংশগ্রহণ সম্প্রসারিত করে। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রার্থীদের সপক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। ফলে জনগণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
১৩. আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা : রাজনৈতিক দল আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থাকে। দলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে উভয় বিভাগের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা এবং অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ একই সাথে শাসন বিভাগ ও আইনসভার সদস্য। ফলে উভয় বিভাগের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব-বিরোধ দেখা যায় না। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতি ও আইন বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধের অবসান ঘটায় ।
১৪. বিকল্প সরকারের ভূমিকা পালন : প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোট সরকার গঠন করে এবং অন্যান্য দল বা জোট বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বিরোধী দলের মূল ভূমিকা হলো সরকারের নীতি ও কর্মকাণ্ডের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করা। সরকারি দল যাতে জনস্বার্থ বিরোধী কাজে লিপ্ত না হয় বিরোধী দল সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। তাছাড়া সরকারি দল যাতে স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে গণতন্ত্রকে পদদলিত করতে না পারে বিরোধী দল সেদিকে সজাগ থাকে। এ সকল কারণে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে বিরোধীদলকে বিকল্প সরকার বলা হয়।
১৫. সরকারের স্থায়িত্ব : সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকারের রিত্বের ব্যাপারেও দলীয় ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দল প্রথার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। এর ফলে সরকারের পিছনে সর্বদা আইনসভার অধিকাংশ সদস্যদের সমর্থন বজায় থাকে। ফলে সরকারের স্থায়িত্বের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা থাকে না। তাই সরকার সুশাসন ও জনকল্যাণ সাধনে পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করতে পারে।
১৬. সুনাগরিক সৃষ্টিতে সহায়তা : রাজনৈতিক দল সুনাগরিক সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। সুনাগরিকের তিনটি অপরিহার্য গুণ হলো বুদ্ধি, আত্মসংযম ও বিবেক। রাজনৈতিক দলের আদর্শ ও লক্ষ্য হলো— ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। রাজনৈতিক দল সুনাগরিকের গুণাবলি চর্চার ক্ষেত্র বৃদ্ধি করে। সুনাগরিক দেশ ও জাতির অমূল্য সম্পদ। ১৭. দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করা : প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের একটি গঠন কাঠামো আছে, যার মাধ্যমে দল পরিচালিত হয় ও দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করা হয়। তাছাড়া প্রত্যেকটি দলের একটি আদর্শ ও কর্মসূচি রয়েছে। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নিজ দলের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষা করে। কেউ দলের গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় অথবা তাকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার বা স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়।
১৮. স্বদেশপ্রেম জাগ্রতকরণ : রাজনৈতিক দল জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে স্বদেশপ্রেম জাগ্রত করে। দলগুলো আঞ্চলিকতা ও সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠে দেশ ও জাতির স্বার্থে জনগণকে একতাবদ্ধ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তৃতা বিবৃতি ও প্রচারের ফলে জনগণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়। জনগণ নিজেদের প্রাণের চেয়েও দেশকে ভালোবাসতে শেখে। সুতরাং রাজনৈতিক দল জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে, যা একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব ও নিরাপত্তার জন্য একান্ত প্রয়োজন ।
১৯. জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি । গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্যবোধ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। সরকারি দল ও বিরোধী দল জাতীয় প্রশ্নে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি মজবুত করে। রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থকেই বড় বলে মনে করে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠে জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্যবোধ সৃষ্টি করে।
২০. সুশাসন প্রতিষ্ঠা : সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। জনগণকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সুষ্ঠুভাবে দেশ শাসন করে থাকে, তারা জনকল্যাণমূলক প্রশাসন গড়ে তোলে এবং প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। বিশেষ করে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
২১. সরকারের চালিকা শক্তি : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের পরিচালিকা শক্তি (Driving force) হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলো সরকারি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে শাসনকার্য পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক দল ব্যতীত যেমন গণতন্ত্র অচল তেমনি সরকারও পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
২২. অধ্যাপক বার্কার (Ernest Barker ) –এর মতে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাফল্যের সাথে পরিচালনা করতে হলে রাজনৈতিক দলের দুটি শর্ত পালন করতে হবে। যথা- ক. বহু রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকবে, খ. প্রত্যেকটি দল কতকগুলো সাধারণ ধারণা বা মতামতের প্রতি ভূমিকা পালন করবে। দল কোনো বিশেষ স্বার্থের প্রতিভূ নয় বরং জাতীয় স্বার্থের প্রতিভূ। পরিশেষে বলা যায়, একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক দল ব্যতীত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কথা কল্পনা করা যায় না। কেননা গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক দল একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব সংরক্ষণে রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ভি. ও. কী (VO Key) বলেছেন, “রাজনৈতিক দল একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মৌল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে।” (Political parties constitute a basic element of democratic institutional process.) রাজনৈতিক দল ব্যতীত সংসদীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দল প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রকে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখে। অধ্যাপক ফাইনার (Finer) বলেছেন, “গণতন্ত্র তার আশা-নিরাশা সমেত দল ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল।” (Democracy rests in its hopes and doubts upon the party system. There is political centre of gravity.)