যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ত্রুটি

যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ত্রুটি বা অসুবিধাসমূহ Criticism or Demerits of Federal Government

 

যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় সুবিধার পাশাপাশি কতিপয় অসুবিধা বিদ্যমান। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও এ ব্যবস্থায় ত্রুটি তুলে ধরেছেন। নিম্নে এ ব্যবস্থার বিভিন্নমুখি ত্রুটি বা অসুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. ক্ষমতার দ্বন্দ্ব : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারসমূহের মধ্যে দ্বন্দ্ব সর্বদা লেগেই থাকে। এ দ্বন্দ্বের ফলে অনেক সময় ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে। এদিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারকে একটি জটিল শাসনব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করা যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওপেনহেইমার (Openhiemer) বলেন, “Distribution of powers between central and state government leads to many conflicts.”

২. আইনি দ্বন্দ্ব : আইনি দ্বন্দ্ব যুক্তরাষ্ট্রের একটি অন্যতম সমস্যা। এতে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট কেন্দ্রিয় আইনসভা ছাড়াও প্রাদেশিক আইনসভা থাকে। ফলে বিভিন্ন আইনসভার প্রণীত আইনের মধ্যে অনেক সময় সামঞ্জস্য থাকে না। আর এতে করে আইনের সংঘর্ষ, আইন ও শাসন প্রক্রিয়ায় অভিন্নতা ও ন্যায়বিচার বিনষ্ট হয়।

৩. সমতা বিধানের সমস্যা : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় প্রশাসনের সকল স্তরে সমতা বিধান সম্ভব হয় না। অঙ্গরাজ্যসমূহ অনেক সময় পরস্পর বিরোধী আইন প্রণয়ন করায় সার্বিক কোনো বিধান কার্যকর করা যায় না। যে কারণে এক প্রদেশের জন্য কোনো কিছু অবৈধ হলে অপর প্রদেশের জন্য তা বৈধ হিসেবে প্রতিপন্ন হয়।

৪. ব্যয়বহুল : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা একটি ব্যয়বহুল শাসনব্যবস্থা। কেননা, এ ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তরে সরকারি কর্তৃত্ব থাকার কারণে অসংখ্য লোকের প্রয়োজন হয়। কেন্দ্রের অনুরূপ ব্যবস্থা প্রদেশের জন্যও গ্রহণ করতে হয় বিধায় যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় বায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। অধ্যাপক ফাইনারের মতে, “এটি একটি ব্যয়বহুল ব্যবস্থা, কারণ তাতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়ায় ব্যাপক বিঘ্ন ঘটে।”

দায়িত্বহীনতা : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় ক্ষমতা বিভাজনের জন্য দায়িত্বহীনতা দেখা দেয়। আর দায়িত্বহীনতার কারণে এক সরকার অপর সরকারের উপর নিজস্ব অপরাধ চাপানোর চেষ্টা করে। নিজের ভুলের জন্য একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকে।

৬. দুর্বল শাসন : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে শাসন ক্ষমতা বণ্টিত হয় বলে একটি শক্তিশালী কেন্দ্ৰীয় সরকার গঠন করা অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, মাঝে মধ্যেই সরকারসমূহের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে কলহ হয়। এ দুর্বলতা বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশেষত প্রকাশ পায়। আর এক্ষেত্রে দ্বিমত দেখা দিলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সরকারের দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়।

৭. বিচ্ছিন্নতার মনোভাব : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় একজন নাগরিককে যদিও কেন্দ্রিয় ও স্বীয় প্রাদেশিক সরকারের প্রতি সমভাবে আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়, তবু আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষার জন্য অঙ্গ রাষ্ট্রের সরকারের প্রতি অধিক পরিমাণে আনুগত্য প্রকাশ করে। এরকম মনোবৃত্তি হতে অনেক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মনোভাবের জন্ম হয়। আর এক্ষেত্রে সরকারের স্থায়িত্ব হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। বিচ্ছিন্ন হবার সুবিধা এককেন্দ্রিক সরকার অপেক্ষা যুক্তরাষ্ট্রেই অধিক। এ প্রক্রিয়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। যেমন- কানাডার কুইবেক রাজ্য এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসমূহ কেন্দ্র হতে বিচ্ছিন্ন হবার চেষ্টা করছে ।

৮. দীর্ঘসূত্রিতা : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা কাজ করে বিধায় জরুরি ও সংকটকালে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়। কারণ এ ব্যবস্থায় বিদ্যমান দ্বৈত প্রশাসন এবং বিভিন্ন সরকারের মতামত ও সহযোগিতা পেতে অনেক সময় নষ্ট হয় ।

৯. শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা : কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন ও প্রয়োগ এবং সাংবিধানিক ব্যাখ্যাকে কেন্দ্র করে এ ধরনের সরকারের মধ্যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। কোনো নতুন বা জটিল সমস্যার সমাধান কেন্দ্র না রাজ্য করবে তা নিয়েও দ্বন্দ্ব দেখা দেয় । ১০. অন্তর্নিহিত দুর্বলতা : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় কেন্দ্রিয় ও আঞ্চলিক সরকারের আন্তঃবিরোধ ও ক্ষমতার এখতিয়ার নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে সম্প্রীতি বিনষ্ট এবং পরিশেষে প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি হয়। লীকক (Lecock)-এর মতে, “যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের এমন কিছু গঠনগত ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে যা যুক্তরাষ্ট্র গঠনের যুগে চোখে পড়েনি।” তিনি আরও বলেন, “বাহ্যিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সফল হলেও অর্থনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে দুর্বল।”

১১. অনমনীয়তা : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় অনমনীয়তা পরিলক্ষিত হয়। কারণ এর সংবিধানের ন্যায় প্রশাসনিক কাঠামো দুষ্পরিবর্তনীয়। যে কারণে এগুলোকে সহজে পরিবর্তন করে প্রয়োজনের সাথে খাপ খাওয়ানো সম্ভব হয় না ।

১২. আদালতের প্রাধান্য : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় আদালতের প্রাধান্য স্থাপিত হয়, যা এধরনের সরকারব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি। আদালত আইনসভার প্রবল প্রতিপক্ষ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে আইনসভা কল্যাণকর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারে না।

১৩. নাগরিকদের উদাসীনতা : যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের উদাসীনতা এই সরকারের অন্যতম ত্রুটি। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র বৃহৎ পরিসরে হয়। কিন্তু নাগরিকরা সাধারণত সচরাচর বৃহৎ রাষ্ট্রে তাল মিলাতে পারে না। এক্ষেত্রে তাঁরা রাজ্যের প্রতি আনুগত্য পোষণ করলেও কেন্দ্রের প্রতি উদাসীনতা প্রকাশ করে।

১৪. বিপ্লবের আশংকা : সংবিধানের দুষ্পরিবর্তনীয় চরিত্র, কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিকতা প্রভৃতি কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্রোহ, বিপ্লব বা গৃহযুদ্ধ দেখা দিতে পারে ।

১৫. কেন্দ্রীয়করণ প্রবণতা : কেন্দ্রীয়করণ প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অন্যতম ত্রুটি। অনেক যুক্তরাষ্ট্র আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের কর্মসূচি গ্রহণ ও পালন করতে গিয়ে কেন্দ্রিয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাদেশিক সরকারের পরিবর্তে জনগণ কেন্দ্রীয় সরকারের উপর অধিক নির্ভর করে। ভারতে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ কেন্দ্রিয়করণ প্রবণতা অধিক পরিলক্ষিত হয়। ১৬. জরুরি পরিস্থিতির অনুপযোগী : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো এটি জরুরি পরিস্থিতির অনুপযোগী। কারণ যুদ্ধ বা যে কোনো প্রকার সংকটকালীন সময়ে দায়িত্ব খণ্ডিত হওয়ার ফলে সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। ১৭. আইন ও শাসন বিভাগের ক্ষমতা সংকুচিত : যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আইন ও শাসন বিভাগের ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে পড়ে। কারণ এ ব্যবস্থায় সংবিধানের ব্যাখ্যা এবং আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন সংবিধানসম্মত কিনা তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। এ ক্ষমতাকে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতা বলে। বিচার বিভাগের এ ধরনের পর্যালোচনা ক্ষমতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেসের ক্ষমতাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। ১৯৩৭ সালে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের প্রস্তাবিত আইন কংগ্রেস পাস করলেও মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট সেই আইনকে অবৈধ ঘোষণা করে। ১৯৬০-এর দশকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও কেন্দ্রিয় সরকারের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করলে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় ।

১৮. পররাষ্ট্র সংক্রান্ত জটিলতা : পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয় ন্দ্রের হাতে থাকলেও এক্ষেত্রে একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। কারণ বৈদেশিক, ক্ষেত্রে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য রাজ্য সরকারগুলোর সম্মতি প্রয়োজন। প্রাদেশিক মতবিরোধ ও আইনসভার বিরোধিতার ফলে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় ।

১৯. প্রগতির পরিপন্থী : প্রগতি বিরোধিতা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের একটি নেতিবাচক দিক। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা দুষ্পরিবর্তনীয় প্রকৃতির হওয়ায় সময়ের প্রয়োজনানুসারে সহজে সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব হয় না। এতে করে প্রগতিশীল যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দেয়। কিন্তু বর্তমান সমাজব্যবস্থা প্রগতির পথে পরিবর্তনশীল । যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের এতসব ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা বিভিন্ন দেশে সফলতা লাভ করেছে। এসব ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকৃতির সরকারব্যবস্থা টিকে আছে। এর কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক এবং তাদের পরস্পরের এখতিয়ারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ।

Leave a Reply