যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের গুণ বা সুবিধাসমূহ . Merits or Advantages of Federal Government
বর্তমান সময়ের একটি বহুল আলোচিত ও কৌশলগত কারণে একটি জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা। নিম্নে এ ধরনের শাসনব্যবস্থার সুবিধা বা গুণাগুণ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. কেন্দ্রিয় সরকারের দায়িত্ব হ্রাস : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় সংবিধানের আলোকে প্রদেশগুলোকে দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়ায় কেন্দ্রিয় সরকার সামগ্রিকভাবে দায়িত্বভারে জর্জরিত হয় না। ফলে, কেন্দ্রিয় সরকার যেমন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিতে মানোনিবেশ করতে পারে, তেমনি আঞ্চলিক সরকারসমূহ কেন্দ্রের উপর নির্ভর না করে স্ব স্ব ক্ষেত্রের দায়িত্ব সঠিক ও সুচারুরূপে পরিচালনা করতে পারে।
২. ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বৈরশাসন রোধ : কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্য স্থাপিত হয় এবং সংবিধান অনুসারে প্রশাসন পরিচালিত হয়। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বৈরশাসন ও স্বেচ্ছাচারিতা দূর করা সম্ভব হয় ।
৩. জাতীয় ঐক্য ও আঞ্চলিক স্বতন্ত্র সত্তার অক্ষুণ্ণতা : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার অন্যতম গুণ হলো এটি বিভিন্ন রাজ্যসমূহকে জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করে। এক্ষত্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের স্বার্থে একত্রিত হলেও নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে। এতে করে নিজেদের স্বায়ত্তশাসন বিনষ্ট হয় না। এ সম্পর্কে অধ্যাপক গার্নার ( Prof. Garner) বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার জাতীয় ঐক্যের সুফলের সাথে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও স্ব-শাসনের অধিকারের সমন্বয় সাধন করে।”
৪. শাসনব্যবস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা সম্ভব হয়। কেননা, এ ব্যবস্থায় কেন্দ্ৰ ও আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা বণ্টনের ফলে কোনো সরকারের উপর অতিরিক্ত কার্যভার আরোপিত হয় না। ফলে সকলেই দক্ষতার সাথে শাসনকার্যে মনযোগী হতে পারে। এতে করে শাসনকার্যের দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং শাসনকার্য পরিচালনা সহজতর হয়।
৫. স্বায়ত্তশাসনের কার্যকারিতা : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অন্যতম সুবিধা হচ্ছে যে, এর মাধ্যমে অঙ্গরাজ্যগুলোর স্বায়ত্তশাসন কার্যকর করা সম্ভব হয়। ফলে প্রাদেশিক সরকার সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে নিজেদের আর্থ-সামাজিক কার্যাদি সম্পাদন করতে পারে। অর্থাৎ, অঙ্গরাজ্যগুলো কেন্দ্রের প্রভাবমুক্ত থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কার্যাদি সম্পন্ন করতে পারে ।
৬. রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় বিপুল সংখ্যক লোক শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে রাজনৈতিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। অঙ্গরাজ্যগুলোর আলাদা সংবিধান, আইনসভা : বিচারালয় থাকে। এতে করে অধিকসংখ্যক লোক শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে নিজেদের মুক্ত চিন্তার দ্বারা শাসনব্যবস্থাকে অধিকতর শক্তিশালী করতে পারে। আর এতে করে এই প্রক্রিয়ায় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষা ও চেতনার প্রসার ঘটে। জে. এস. মিলের (J.S. Mill) ভাষায়, “যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা উত্তম শাসন পরিচালনার জন্য দক্ষ নাগরিক গড়ে তোলে।”
স্থানীয় সমস্যার সমাধান : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের একটি অন্যতম সুবিধা হলো এর মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব। অঙ্গরাজ্যগুলোকে কেন্দ্রিয়ভাবে কতিপয় এখতিয়ার প্রদান করা হয় বিধায় আঞ্চলিক সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য দূরবর্তী কেন্দ্রিয় সরকারের দ্বারস্থ হতে হয় না। আঞ্চলিক সরকারগুলো নিজেরাই নিজেদের স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে সমাধান করতে পারে বিধায় এ ধরনের সরকারব্যবস্থায় দ্রুত স্থানীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব ।
৮. : অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি : অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের একটি বিশেষ গুণ। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় জাতীয় স্বার্থ ও আঞ্চলিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় ঘটে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সঙ্গতির ভিত্তিতে, আঞ্চলিক সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এরূপ পরিস্থিতিতে কেন্দ্র ও অঞ্চল উভয়ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত হয়।
৯. নেতৃত্বের বিকাশ : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় নেতৃত্বের বিকাশ সাধিত হয়। কেননা এ ব্যবস্থায় স্থানীয় কার্যাদি সম্পাদনের দায়িত্ব স্থানীয় জনগণের উপর বর্তায় বিধায় স্থানীয় জনগণ বিভিন্নমুখি স্থানীয় সমস্যার সামাধান নিজেরাই করে থাকে। এমনকি তারা রাষ্ট্রীয় কাজেও অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে বিধায় নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। আর নেতৃত্বের বিকাশ ঘটলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনও কার্যকর হয়।
১০. স্বৈরশাসন রোধ : স্বৈরশাসন রোধের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয় বিধায় কেন্দ্রীয় অঙ্গরাজ্যগুলোর সরকার যাচ্ছেতাই করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারকে সর্বদা সংবিধান অনুসরণ করতে হয় বিধায় স্বৈরশাসন প্রতিহত হয়।
১১. বৃহৎ রাষ্ট্রের উপযোগী : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার বৃহৎ রাষ্ট্রের জন্য উপযোগী একটি সরকারব্যবস্থা। বৃহৎ রাষ্ট্র বহু ধর্ম, বর্ণ ও জাতি গোষ্ঠীর লোক নিয়ে গঠিত। রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংহতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বিকল্প নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্য আনয়ন করে ।
১২. জাতীয় ঐক্য : জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের একটি উত্তম দিক। এ ধরনের সরকারব্যবস্থায় স্বায়ত্তশাসনের ফলে প্রদেশগুলোতে জাতীয় ঐক্যবোধ তৈরি হয়। প্রাদেশিক সরকারসমূহ ঐক্যবদ্ধ হলে জাতীয় সংহতি বৃদ্ধি পায়। জাতীয় সংহতি বৃদ্ধি পেলে জাতীয় প্রশাসনে সংহতি আসে ।
১৩. দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয় : দেশাত্মবোধ জাগ্রতকরণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রদেশসমূহে স্বায়ত্তশাসনের নীতি অনুসৃত হওয়ায় জনগণের মধ্যে আঞ্চলিক চেতনা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সামগ্রিকভাবে জনসাধারণের মধ্যে স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হয়। আর স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হলে জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। আইনশৃঙ্খলা মেনে চলাসহ জনগণ তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়।
১৪. বিপ্লবের আশঙ্কা হ্রাস : যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের ফলে বিপ্লবের সম্ভাবনা কম থাকে। এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় সামরিক বাহিনী বা বিদ্রোহী কোনো শ্রেণি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত থাকায় বিপ্লব হওয়ার সম্ভাবনা কম। উপরন্তু কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকার সংবিধান অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করে বিধায় তারা জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। এতে জনগণের মধ্যে অসন্তোষের সম্ভাবনা কম থাকে। ফলে কোনো দল বা গোষ্ঠী বিপ্লবের ডাক দেয় না । ১৫. বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হওয়া : যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল একত্রে মিলিত হয়ে একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হয়। বিচ্ছিন্নভাবে অঞ্চলগুলোর মর্যাদা ও অবস্থান তেমন সুদৃঢ় না হলেও যুক্তরাষ্ট্র গঠনের ফলে এসব অঞ্চল সম্মিলিতভাবে বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হতে পারে। এতে আঞ্চলিক সত্তা ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকার খর্ব হয় না। এখানে মিলন ও বিচ্ছেদের অধিকার একই সাথে ভোগ করা যায়। বলা যায়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল নিয়ে শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হওয়ার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয় ৷
১৬. পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধা : যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অঙ্গরাজ্যগুলো আইন প্রণয়ন ও শাসনক্ষেত্রে নতুন ব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করতে পারে। এরূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল সমগ্র দেশে গৃহীত হতে পারে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা সফল হলে রাষ্ট্রের সর্বত্র তা প্রয়োগ করা যায়।
১৭. ক্ষতি ও অপচয়ের ঝুঁকি হ্রাস : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের কোনো প্রদেশে কোনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগের পরীক্ষা- নিরীক্ষা সফল প্রমাণিত হলে তা অন্যান্য প্রদেশে প্রয়োগ করা যায়। এতে বার বার এবং বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। ফলে জাতীয় ক্ষতি ও অপচয়ের ঝুঁকি থাকে না ।
১৮. আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্য হ্রাস : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্য হ্রাসে সহায়তা করে। অঙ্গরাজ্যগুলোর সরকার আঞ্চলিক সমস্যা, দাবি ও প্রয়োজন সম্পর্কে অবহিত থাকে। অঞ্চলের জনসাধারণের সাথে রাজনৈতিক প্রশাসকদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ সুশাসনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। ফলে আমলাদের প্রাধান্য হ্রাস পায় ।
১৯. জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধি : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রের জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। সুশাসন, স্বদেশপ্রেম, নাগরিকদের মনস্তাত্ত্বিক সন্তুষ্টি, বৃহৎ রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের গৌরববোধ প্রভৃতি যুক্তরাষ্ট্রে অর্জিত হয়। যেমন : গুজরাটের নাগরিকত্বের চেয়ে ভারতের নাগরিকত্ব শ্রেয়।
২০. আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সরকারসমূহ ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং বলা যায়, যে রাষ্ট্রের আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যের বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত প্রবল সেখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারই এধরনের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের একমাত্র মাধ্যম ।
২১. আন্তর্জাতিক উত্তেজনা প্রশমন : যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক উত্তেজনা প্রশমিত হয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যা অধিক হলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উত্তেজনা দেখা দিবে। শক্তিশালী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো ক্ষুদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে অধিকার করার জন্য আক্রমণ করবে। ফলে যুদ্ধের আশংকা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর একত্রীকরণের মাধ্যমে এধরনের যুদ্ধের আশংকা হ্রাস করা সম্ভব।
উল্লিখিত গুণাবলি বা সুবিধাসমূহ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উত্তম দিককে তুলে ধরে। কিন্তু গুণাবলির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার কিছু কিছু ত্রুটিও বিদ্যমান। যদিও এসকল সুবিধা বা গুণাবলি ত্রুটি বা অসুবিধাসমূহকে অতিক্রম করতে সক্ষম। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস না পেয়ে বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলস্বরূপ বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা একটি নন্দিত সরকারব্যবস্থা ।