Table of Contents
Toggleমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি
Principle of Separation of Power
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতির প্রয়োগ ৩.২.খ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির কার্যকারিতা হ্রাস
মার্কিন শাসনতন্ত্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণের পাশাপাশি ক্ষমতার পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মার্কিন প্রশাসন ব্যবস্থার অন্যতম মূল সূত্র হলো ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি। স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের সংরক্ষণ এবং প্রশাসনিক গতিশীলতা নিশ্চিতকরণই ছিল এ নীতির মূল লক্ষ্য। অষ্টাদশ শতাব্দির আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে মার্কিন সংবিধান রচয়িতাগণ নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতিটি পরিকল্পনা করেছিলেন । কিন্তু পরবর্তীকালে পরিবর্তিত পরিবেশে নীতিটি তার প্রাসঙ্গিকতা অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলে। ফলে কখনো শাসন বিভাগ আইন বিভাগের উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছে। আবার কখনো আইন বিভাগ শাসন বিভাগের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতিটি সফল হয় নি ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি
Principle of Separation of Power
ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলতে ক্ষমতা পৃথকীকরণকে বোঝায়। যেখানে সরকারের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ নিজ নিজ কাজে স্বাধীন থাকবে এবং এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না।
ফেডারলিস্ট ম্যাডিসন-এর মতে, “ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ হলো এমন এক নীতি, যার অনুপস্থিতিতে সরকার স্বেচ্ছাচারী হতে বাধ্য ।”
গু মনীষী লিপসন-এর ভাষায়, “ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ হলো সংবিধান অনুসারে সরকারের ক্ষমতা পৃথকীকরণ যা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ম্যাডিসন-এর মতে, “ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ হচ্ছে সরকারের তিনটি বিভাগের উপর ন্যস্ত ক্ষমতার পৃথক পৃথক ব্যবহার ও নিশ্চিত প্রয়োগ যেখানে একে অপরের এখতিয়ারের হস্তক্ষেপমুক্ত।”
* মন্টেস্কু (Montesquieu) তাঁর “The Spirit of Laws” গ্রন্থে বলেন, “ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ বলতে বুঝায় এমন এক প্রক্রিয়াকে যেখানে সরকারের ত্রিবিধ বিভাগের ক্ষমতা সম্পূর্ণ পৃথক হবে এবং কেউ কারও কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।” মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির তিনটি দিক রয়েছে :
ক. একই ব্যক্তি আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের একাধিক সংগঠনে থাকতে পারবে না।
খ. উপরোক্ত তিন সংগঠনের এক সংগঠন অপর সংগঠনের কাজে বাধা দেবে না কিংবা অন্য সংগঠনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করবে না।
গ. এক সংগঠন অন্য সংগঠনের কাজ সম্পাদন করবে না। কেননা মন্টেস্কুর মতে, সব কিছুরই সীমা থাকা দরকার, এমনকি মহৎ গুণেরও (Virtue itself must have its limits)।
আর. সি. আগারওয়াল (R. C. Agarwall) -এর মতে, “Where all the power of the governrnent are not be concerned in the hands of one organ is called separation of power.”
ও ইংল্যান্ডের আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্ল্যাকস্টোন ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণকে আরও সুস্পষ্ট করে বলেন, “The accumulation of all power in the same hands may justly be pronounced the vary definition of tyranny.”
সুতরাং ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলতে আমরা এমন এক নীতিকে বুঝি যে নীতির আওতায় সরকারের আইন, শাসন বিচার বিভাগ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র থাকবে এবং প্রত্যেক বিভাগ একে অপরের হস্তক্ষেপমুক্ত হয়ে কাজ করবে।
রোমান দার্শনিক পলিবিয়াস (Polybius) ও সিসেরো (Cicero), ফরাসি দার্শনিক বডিন (Bodin), ইংরেজ দার্শনিক লক (locke) ও হ্যারিংটন (Harrington) প্রমুখ চিন্তাবিদদের রচনায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রকাশ ঘটলেও ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু (Montesquieu) এবং ইংরেজ চিন্তাবিদ ব্ল্যাকস্টোন (Blackstone) -এর হাতে নীতিটির চরম বিকাশ সাধিত হয়। মন্টেস্কুর মতে, কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদের হাতে আইন ও শাসন বিষয়ক ক্ষমতা ন্যস্ত থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তি-সংসদ স্বৈরাচারী আইন তৈরি করে যথেচ্ছভাবে প্রয়োগ করতে পারে। ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যাহত হয়। তাই ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের স্বার্থেই ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নী৬ি অপরিহার্য। ব্ল্যাকস্টোন (Blackstone) -এর অভিমত হলো জনসাধারণের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতা সংরক্ষণের স্বার্থে সরকারের বিভাগসমূহের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন । ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো :
ক. সরকারের তিনটি বিভাগ পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র থাকবে;
খ. এক বিভাগ অপর কোনো বিভাগের কাজ করবে না;
গ. একই ব্যক্তি একাধিক কোনো বিভাগের সাথে যুক্ত থাকবে না; ঘ. এক বিভাগ অপর কোনো বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করবে না ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির উদ্ভবের প্রেক্ষাপট
Background of Origin of the Doctrine of Separation of Power in USA
মার্কিন সংবিধানে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে প্রধান মৌল নীতি হিসেবে স্বীকার করা হলেও কোনো প্রকার সাধারণ অনুভূতিমূলক প্রবণতার বশবর্তী হয়ে সংবিধান প্রণেতাগণ ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি গ্রহণ করেন নি বরং তৎকালীন ঐতিহাসিক বাস্তবতাই তাঁদেরকে ঐ নীতির প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। উপনিবেশিক শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় জর্জরিত তৎকালীন নেতৃবৃন্দ অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, সরকারের সকল ক্ষমতা একই ব্যক্তি বা সংস্থার হাতে ন্যস্ত হলে স্বৈরাচারী মনোভাবের জন্ম নিতে বাধ্য। আর এ ধরনের অভিজ্ঞতাই ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি গ্রহণে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
উপরন্তু জন লক ও মন্টেস্কুর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তাধারা ও ক্ষমতাবিভাজন সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা দ্বারা মার্কিন সংবিধান প্রণেতাগণ প্রভাবিত হয়েছিলেন। কেননা, ১৭৮৭ সালে মার্কিন সংবিধান প্রণয়নের সময় জন লক ও মন্টেস্কুর মতবাদের প্রভাবই ছিল সর্বাধিক। ‘স্বাভাবিক অধিকার’ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রচার করেছিলেন লক এবং একে স্বাধীনতার মূল মন্ত্রে পরিণত করেছিলেন মন্টেস্কু। ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু তাঁর ‘The Spirit of the Laws’ গ্রন্থে যুক্তি প্রদর্শন করে বলেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে সরকারে আইন প্রণয়নগত, শাসন ও বিচার বিভাগীয় এ তিন ধরনের ক্ষমতাকে অবশ্যই পৃথক পৃথক ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর হাতে সুনির্দিষ্টভাবে অর্পণ করতে হবে। কিন্তু একই ব্যক্তির বা বিভাগের হাতে একাধিক ধরনের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হলে উক্ত ব্যক্তি বা বিভাগ স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে। মন্টেস্কুর এমনতর যুক্তি স্বাধীনতাকামী মার্কিন উপনিবেশিকদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাই তারা মনে করেন যে, মার্কিন সংবিধান আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের স্বতন্ত্র ক্ষমতার ভিত্তির উপরই স্থাপিত হবে। তা না হলে মানুষের অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যাহত হবে। এভাবে মার্কিন সংবিধান প্রণেতাগণ লক ও মন্টেস্কুর তত্ত্বের মধ্যে ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণ ও স্বৈরাচার প্রতিরোধের কার্যকর সমাধানের সন্ধান পেয়েছিলেন। আর এ স্বৈরাচারী ক্ষমতার অপব্যবহার রোধকল্পে সংবিধান প্রণয়নকারীগণ ক্ষমতা- স্বতন্ত্রীকরণ নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ হয়ে
Application of the Doctrine of Separatioin of Powers in USA
ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষিত না হলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার যেমন ক্ষুণ্ণ হয়, তেমনি আবার ক্ষমতা এক হাতে কেন্দ্রীভূত হলে অন্যান্য বিভাগের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যে কারণে এ্যারিস্টটল, সিসেরো, অ্যা রডিন, জন লক ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। তবে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের বিভক্তিকরণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্টেস্কু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণেতাগণ মন্টেস্কুর ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির দ্বারা প্রভাবিত ঐ দেশের সংবিধানে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা বিভক্ত করে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। মার্কিন সংবিধান প্রণয়ণের প্রাক্কালে হ্যামিল্টন, ম্যাডিসন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির পক্ষে দৃঢ় যুক্তির অবতারণা করেন। ফলে নীতিটি মার্কিন শাসনব্যবস্থায় বিশেষ গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা হয়। সরকারের তিনটি বিভাগ পরস্পরের প্রভাবমুক্ত অবস্থায় যাতে নিজ নিজ বিভাগীয় দায়িত্ব সম্পাদন করতে পারে সে বিষয়ে মার্কিন সংবিধান প্রণেতাগণ সতর্কতার সাথে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। আর এ লক্ষ্যে:
ও মার্কিন সংবিধানের ১নং অনুচ্ছেদে আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত যাবতীয় ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মার্কিন সংবিধানের ভাষ্য হলো, “All legislative powers herein granted shall be vested in a Congress of the United States” (Article-1)
o মার্কিন সংবিধানের ২নং অনুচ্ছেদে শাসন বিষয়ক সকল ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নিকট ন্যস্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মার্কিন সংবিধানের ভাষ্য হলো, “The executive powers shall be vested in a president of the United States of America” (Article-II)
o মার্কিন সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদে বিচার সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা বিচার বিভাগের নিকট ন্যস্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মার্কিন সংবিধানের ভাষ্য হলো, “The judicial powers of the United State shall be vested in one Supreme Court and in such inferior courts as the Congress may from time to time origin and establish” (Article-III).
এভাবে আইন, শাসন ও বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা পৃথক পৃথকভাবে তিনটি বিভাগের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে, যাতে করে এক বিভাগ অপর বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকে। সিনেট ও প্রতিনিধিসভার সমন্বয়ে গঠিত কংগ্রেসের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। কংগ্রেসের উভয় কক্ষের অধিবেশন ও কার্যকাল নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে নির্ধারিত ও পরিচালিত হয়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের সদস্য নন এবং কংগ্রেসের কোনো কক্ষ ভেঙে দেয়ার ক্ষমতাও তাঁর নেই। মার্কিন কংগ্রেস সকল বিলের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করে ও আইন প্রণয়ন করে। রাষ্ট্রপতি কোনো বিলের ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারেন, কিন্তু আইন প্রণয়নে কংগ্রেসকে বাধ্য করতে পারেন না। আবার মার্কিন সুপ্রিম কোর্টও কংগ্রেসের কার্যাবলির সাথে যুক্ত নয় ।
রাষ্ট্রপতি হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসন বিষয়ক সকল ক্ষমতার অধিকারী। প্রশাসনিক বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে সহায়তা করার জন্য সচিবদের (মন্ত্রী) নিয়োগ করা হয়। এদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। রাষ্ট্রপতি বা তাঁর সচিবগণ যেমন কংগ্রেসকে প্রভাবিত করতে পারেন না, তেমনি আবার তাঁরা কংগ্রেসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিতও হন না।
অনুরূপভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিষয়ক যাবতীয় দায়িত্ব সম্পাদন করে সুপ্রিম কোর্ট এবং অধস্তন আদালতসমূহ । সুপ্রিম কোর্টের উপর কংগ্রেস বা রাষ্ট্রপতির কোনো কর্তৃত্ব নেই। বিচার সংক্রান্ত কাজকর্ম সুপ্রিম কোর্ট স্বাধীনভাবে সম্পাদন করে। বিচার বিভাগের উপর রাষ্ট্রপতি বা কংগ্রেসের কোনো প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ থাকে না ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগের প্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে যে, মার্কিন সংবিধান প্রণেতাগণ আইন, শাসন ও বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা তিনটি বিভাগের হাতে ন্যস্ত করেই নিশ্চিত থাকেন নি, এক বিভাগ যাতে অন্য বিভাগের তুলনায় শক্তিশালী হয়ে প্রভুত্ব বিস্তার করতে কিংবা স্বৈরতন্ত্রী হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য সচেতন মনোভাব অবলম্বন করেছেন। তাঁরা প্রতিটি বিভাগের ক্ষমতাকে নির্দিষ্ট করে সীমাবদ্ধ সরকারের নীতি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। যে কারণে মার্কিন শাসনব্যবস্থাকে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপযুক্ত উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির সীমাবদ্ধতা
Limitations of the Doctrine of Separation of Powers in USA
মার্কিন সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে প্রতিপন্ন করা হলেও বাস্তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পরিপূর্ণ প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব হয়নি। কেননা, কার্যক্ষেত্রে মার্কিন শাসনব্যবস্থায় প্রতিটি বিভাগের উপর অপর দুই বিভাগের কিছু কিছু নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। যেমন—
ক. আইন প্রণয়নের সকল ক্ষমতা মার্কিন কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত থাকলেও রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসে ‘আইন প্রণয়নের দাবি সম্বলিত বাণী’ (Presidential Message) প্রেরণ করতে পারেন। আবার রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর ব্যতীত কংগ্রেস কর্তৃক পা কোনো বিল আইনে পরিণত হয় না। এভাবে শাসনবিভাগীয় ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্রপতি আইনবিভাগীয় ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট আইনের ব্যাখ্যা ও বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা (Judicial Review) এর মাধ্যমে কংগ্রেস প্রণীত আইনকে বাতিল করে দিতে পারেন ।
খ. শাসন বিষয়ক যাবতীয় ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নিকট ন্যস্ত থাকলেও শাসনকার্য পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যর-বরাদ্দ মঞ্জুরির ক্ষমতা কংগ্রেসের হাতে রয়েছে। আন্তর্জাতিক সন্ধি বা চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট-এর অনুমোদন সাপেক্ষ। সিনেটের অনুমোদন ব্যতীত রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে কাউকে নিযুক্ত করতে পারেন না সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ প্রতিরক্ষা সচিব পদে জন টাওয়ার-এর নাম প্রস্তাব করলেও সিনেট এ প্রস্তাব অনুমোদন না করে বাতিল করে দেয়। মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট আইনের ব্যাখ্যা ও বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা এর মাধ্যমে কংগ্রেস প্রণীত আইনকে যেমন বাতিল করতে পারে তেমনি একই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতির নির্দেশও বাতিল করে দিতে পারে ।
গ. মার্কিন বিচার বিভাগের উপর বিচারিক ক্ষমতা অর্পণ করা হলেও এবং বিচার বিভাগ আইন ও শাসন বিভাগীয় কার্যক্রমের উপর হস্তক্ষেপ করে ‘অনির্বাচিত সর্বোচ্চ আইনসভা’ হিসেবে আখ্যা লাভ করলেও বিচার বিভাগ স্বয়ং অপর দুই বিভাগের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত নয় । কেননা, শাসন বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগ প্রদান করে। অধিকন্তু রাষ্ট্রপতির এ সংক্রান্ত নিয়োগ আবার কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট কর্তৃক অনুমোদিত হতে হয়। তাছাড়া কংগ্রেস নিম্নতম আদালত গঠন করে এবং সিনেট ইমপিচমেন্ট বিচার করে। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ড মওকুফ কিংবা হ্রাস করতে পারেন ।
মার্কসবাদী সমালোচকদের মতানুসারে মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার আর্থ-সামাজিক বিন্যাসের উপর ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ বহুলাংশে নির্ভরশীল। কার্যক্ষেত্রে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণকে এ নীতি আটকাতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিপতি শ্রেণি সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। তবে কাঠামোগত বিচারে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসৃত হয়েছে। মার্কিন আর্থ-সামাজিক কাঠামোতে যে শ্রেণি কর্তৃত্ব করে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে না যাওয়া পর্যন্তই কেবল ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি কার্যকর হয়। এসকল সমালোচক আরও অভিমত প্রকাশ করে বলেন, ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ সত্ত্বেও মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট সামগ্রিকভাবে মার্কিন জনসাধারণের ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণ করতে পারে নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি
প্রমুখ বিত্তবান শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য সুপ্রিম কোর্ট তার ক্ষমতা ব্যবহার করছে। সুপ্রিম কোর্ট অনেক সময় শ্রমিক স্বার্থবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছে এবং জনকল্যাণমুখি আইনের ব্যাপারে সহানুভূতি দেখায় নি। এ সম্পর্কে অ্যালেন পটার বলেন, “The important period of judicial protection of economic rights from government action, however, was the half century from 1886 to 1936. The chief beneficiaries were the wealthy and business classes.”
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির যথার্থ প্রয়োগ ঘটেনি। মার্কিন শাসনব্যবস্থায় সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার বহু ক্ষেত্র রয়েছে। নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির প্রয়োগের ফলে সরকারের প্রতিটি বিভাগই অপর দুটি বিভাগের দ্বারা অল্পবিস্তর নিয়ন্ত্রিত হয়। ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির পরিপূর্ণ প্রয়োগ বাস্তবে যে অসম্ভব এ বিষয়ে মার্কিন সংবিধানের অভিজ্ঞ রূপকারগণ সম্যকরূপে অবহিত ছিলেন। যে কারণে তাঁরা বাস্তব প্রয়োজনে সংবিধানে ‘নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি’র মাধ্যমে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির ক্ষেত্রে কিছুটা সংশোধন ও নমনীয়তা আনয়ন করেন ।
পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি
Principle of Check and Balance
ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিপরীত নীতি হলো পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি। এ নীতির দ্বারা সরকারের তিনটি বিভাগের ক্ষমতা প্রয়োগের মধ্যে একটি ভারসাম্য সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ, যে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারের তিনটি বিভাগের প্রত্যেকটি এমন কতগুলো আনুষ্ঠানিক উপায় লাভ করে যার দ্বারা উক্ত বিভাগটি অপর দুটি বিভাগ কর্তৃক স্ব স্ব সাংবিধানিক ক্ষমতার লঙ্ঘনকে নিবৃত্ত করতে পারে, তাকে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি’ (Principle of Check and Balance) বলা হয়। হ্যামিল্টন ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ-এর মতে, “এ ব্যবস্থা এমনভাবে সরকারের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর বিন্যাস করে, যাতে করে এর বিভিন্ন বিভাগ এদের পারস্পরিক সম্পর্কাদির মাধ্যমে অন্যান্য প্রত্যেক বিভাগকে এর নিজস্ব যথার্থ. এখতিয়ারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারে।”
বস্তুত কোনো সংবিধানে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা পৃথক পৃথকভাবে বণ্টন করার যে নীতি গ্রহণ করা হয়, সে নীতিকে কার্যত বজায় রাখার, অর্থাৎ প্রত্যেক ভিাগকে স্ব স্ব এখতিয়ার লঙ্ঘন হতে নিবৃত্ত রাখার লক্ষ্যেই ‘নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি’ একটি উপযোগী পন্থা হিসেবে গণ্য হয়। কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি তখনই গৃহীত হয়, যখন কোনো কার্য পালনের দায়িত্ব কোনো এক ব্যক্তি বা বিভাগের হাতে সম্পূর্ণ ন্যস্ত করা হয় না, বরং বেশ স্বাধীন এমন অন্যান্য বিভাগকেও সে কার্য সম্পাদনের বিষয়ে অংশ বা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রদান করা হয়। আর এভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপের মাধ্যমে যে কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ‘ভারসাম্য’ বজায় রাখা সম্ভব হয়ে থাকে ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতির প্রয়োগ
Application of the Principle of Check and Balance in USA
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের তাত্ত্বিক ভিত্তি ‘ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি’র উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও ব্যবহারিক ভিত্তি ‘ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি’র উপর প্রতিষ্ঠিত। যে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির সাথে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি সম্পৃক্ত থেকে উক্ত শাসনব্যবস্থাকে একটি পৃথক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। মার্কিন সংবিধানের বিভিন্ন অংশে এ নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। অগ (Ogg)-এর মতে, “No feature of the American Government, national state often local, is more characteristic than the seperation of powers, combined with precautionary checks and balances.” যে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতিকে দুটি উপায়ে প্রয়োগ করা হয়েছে। যথা— প্রতিষ্ঠানগত নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার ব্যবহার সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে কীভাবে বিভিন্ন বিভাগের কার্যাবলির মধ্যে পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়েছে তা আলোচনা করতে হলে শাসন, বিচার ও আইন বিভাগের উপর পরস্পরের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি পৃথক পৃথকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :
ক. আইন বিভাগ কর্তৃক শাসন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ : রাষ্ট্রপতি শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেও তার ক্ষমতা অনেকক্ষেত্রে আইন বিভাগ তথা মার্কিন কংগ্রেস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
6) শাসন বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি চার বছরের জন্য নির্বাচিত হলেও তাঁর কার্যকাল শেষ হবার পূর্বেই কংগ্রেস যে কোনো গুরুতর অপরাধের অভিযোগে ইমপিচমেন্টের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারে ।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি সে দেশের সকল পদস্থ কর্মকর্তাকে নিয়োগ প্রদান করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন বিভাগের সকল কর্মচারী, রাষ্ট্রদূত, কেবিনেট সদস্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের বিচারপতিদের নিয়োগ প্রদান করেন। তবে রাষ্ট্রপতির নিয়োগ সম্পর্কিত ক্ষমতাকে কার্যকর করতে হলে সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের প্রয়োজন হয়। যদি সিনেট রাষ্ট্রপতির এই নিয়োগকে অনুমোদন না করে তবে তা অবৈধ বলে বিবেচিত হয়। যেমন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ প্রতিরক্ষা সচিব পদে জন টাওয়ার-এর নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু মার্কিন সিনেট সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তা বাতিল করে দেয়।
কংগ্রেস নিজস্ব ক্ষমতায় আইন প্রণয়ন করতে পারে। আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রপতির উত্থাপিত প্রস্তাবও কংগ্রেস বাতিল করতে পারে।
শাসন বিভাগের কার্য পরিচালনার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু কংগ্রেসের অনুমোদন ব্যতীত জাতীয় বাজেট যেমন পাস হয় না, তেমনি কোনো কর ধার্য বা বিলোপ অথবা সরকারি তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করা সম্ভব নয় । এভাবে রাষ্ট্রপতির উপরে কংগ্রেস নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে ।
মার্কিন সিনেট রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, বিচারপতি ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের আনীত অভিযোগের বিচার করতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতিনিধিসভা রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে চার্জশীট প্রস্তুত করবে এবং সিনেট রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট দোষে দোষী কি-না তা দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
রাষ্ট্রপতি কংগ্রেস প্রণীত আইনে ‘ভেটো’ প্রয়োগ করতে পারেন। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেস দ্বিতীয় বার দুই-তৃতীয়াংশ সম্মতি সাপেক্ষে বিলটি পুনরায় পাস করার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির ভেটোকে বাতিল করে দিতে পারে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিক্সনের ভেটোকে বাতিল করে কংগ্রেস কর্তৃক ‘War powers act’ প্রণয়ন এর কথা উল্লেখ করা যায় ৷
্ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে কোনো রাষ্ট্রের সাথে সন্ধি-চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে মার্কিন রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু তাঁর সম্পাদিত এসকল সন্ধি-চুক্তি কংগ্রেসের উচ্চ * সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে অনুমোদন না হলে কার্যকর হয় না। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি উইলসন ভার্সাই সন্ধি এবং জাতিসংঘের চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন। কিন্তু মার্কিন সিনেট তা অনুমোদন করেনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জরুরি পরিস্থিতিতে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন। তবে সেই ঘোষণা পরবর্তীতে আইনসভায় অনুমোদন করতে হয় ।
খ. শাসন বিভাগ কর্তৃক আইন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ : আইন বিভাগ যেমন শাসন বিভাগকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তেমনি বিপরীতে শাসন বিভাগও আইন বিভাগকে কতিপয় ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। নিম্নে এসম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আইন বিভাগ তথা কংগ্রেসের উপর ন্যস্ত। রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসে তাঁর অনুরোধ সংক্রান্ত বাণী (Presidential Message) প্রেরণ করতে পারেন। কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির এই বাণী আলোচনা করতে বাধ্য। তবে ঐ বাণীর বিষয়বস্তু প্রত্যাখানের ক্ষমতাও কংগ্রেসের রয়েছে।
মার্কিন আইনসভা তথা কংগ্রেস প্রণীত আইন রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ব্যতীত কার্যকর হয় না। রাষ্ট্রপতি কংগ্রেস প্রণীত যে কোনো আইন বা বিলে ভেটো (Veto) প্রয়োগের মাধ্যমে উক্ত আইনকে আটকে দিতে পারেন। যদিও মার্কিন কংগ্রেস দ্বিতীয় বার দুই-তৃতীয়াংশ সম্মতি সাপেক্ষে অনুমোদন করলে রাষ্ট্রপতি তাতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য থাকেন, অথবা তাঁর অনুমতি ব্যতীত বিলটি আইনে পরিণত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ৩৭২টি সাধারণ ভেটো এবং ২৬৩টি পকেট ভেটো প্রদানের মাধ্যমে আইন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করে থাকেন। এক্ষেত্রে তিনি কংগ্রেসের উভয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি উইলসন ১৯১৩ সালে কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করেছিলেন।
গ. বিচার বিভাগ কর্তৃক শাসন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ : বিচার বিভাগ শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এরূপ নিয়ন্ত্রণের সাংবিধানিক কৌশলসমূহ হলো :
বিচার বিভাগও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। রাষ্ট্রপতির কোনো নির্দেশ, তাঁর দ্বারা সম্পাদিত কোনো চুক্তি ও সন্ধির বৈধতা বিচারের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত। অর্থাৎ, রাষ্ট্রপতির এ সংক্রান্ত সাংবিধানিক এখতিয়ার বহির্ভূত বা আইনের যথাযথ পদ্ধতির বিরোধী হলে আদালত একে বাতিল ঘোষণা করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগীয় এ সাংবিধানিক প্রাধান্য রাষ্ট্রপতির কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রপতি ইস্পাত কারখানা সরকার কর্তৃক দখলের আদেশ জারি করলে আদালত এ সংক্রান্ত আদেশকে বাতিল করে দেয়।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নিকট শপথ গ্রহণ করে সংবিধানকে সমর্থন ও রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন, যা মনস্তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্রপতির উপর নৈতিক বাধা হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে।
* আদালত রীট জারী করে শাসন বিভাগের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে ৷
ঘ. শাসন বিভাগ কর্তৃক বিচার বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পায়। তাদের বেতন-ভাতা সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার জন্য অপর কোনো সংস্থার উপর নির্ভর করতে না হলেও কতিপয় ক্ষেত্রে শাসন বিভাগ বিচার বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে :
ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি মার্কিন বিচারপতিদের নিয়োগ করে থাকেন। যদিও এ নিয়োগ সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষে তথাপি এ নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিচার বিবেচনার প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। এর মাধ্যমে শাসন বিভাগ বিচার বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ।
ও মার্কিন রাষ্ট্রপতি ইমপিচমেন্ট ব্যতীত আদালত কর্তৃক যে কোনো শাস্তি বা দণ্ড মওকুফ, হ্রাস বা বাতিল করে দিতে পারে। এ ক্ষমতা প্রয়োগের ফলে বিচার বিভাগের কার্যক্রম রাষ্ট্রপতি তথা শাসন বিভাগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে ।
রাষ্ট্রপতি আদালতের রায়কে কার্যকরী করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে আদালতকে অসহায় অবস্থায় ফেলতে পারে । ঙ. আইন বিভাগ কর্তৃক বিচার বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ : মার্কিন বিচার বিভাগের উপর কংগ্রেস বা আইন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ :
ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধঃস্তন আদালতের গঠন, বিলোপ সাধন ও বিভিন্ন জাতীয় আদালতের এখতিয়ার কংগ্রেসের হাতে ন্যস্ত থাকে । এর ফলে বিচার বিভাগের উপর কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে ।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ প্রদান করলেও এ নিয়োগ কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষ। ফলে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনার প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।
বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত রোধ এবং বিধি-নিষেধ অপসারণের উদ্দেশ্যে কংগ্রেস আইন প্রণয়ন করতে পারে ।
বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন বিভাগ যে কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে। ফলে বিচারবিভাগ তথা সুপ্রিমকোর্ট অসহায় অবস্থার মধ্যে পতিত হয় ।
চ. বিচার বিভাগ কর্তৃক আইন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ : মার্কিন কংগ্রেসের উপর বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রয়েছে।
মার্কিন কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত যে কোনো আইনের বৈধতা বিচার করার ক্ষমতা আদালতের রয়েছে। বিচার্য আইনটি সংবিধান বিরোধী হলে আদালত অসাংবিধানিকতার দায়ে তা বাতিল করে দিতে পারে ।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বিরাজমান পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতিকে নিম্নের ছকে উপস্থাপন করা যায় :
আইন বিভাগ
শাসন বিভাগ
বিচার বিভাগ
চিত্র : ক্ষমতার পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি
সুতরাং বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি বিদ্যমান থেকে সংবিধানের ভিত্তি ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রিত করে সমগ্র শাসনব্যবস্থায় এক গভীর যোগসূত্র স্থাপন করে একে গতিশীলতা দান করেছে। পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির স্বপক্ষে বলতে গিয়ে Fanlkner and Kepner বলেন যে, “Thus in theory, Congress could not become too unreasonable in the laws it passed; the president could not become a dictator and the courts could not oppose forever the other two branches of Government”. (Fanlkner and Kepner, America: Its History and People, Ch. 5, p-139)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির কার্যকারিতা হ্রাস
Decrease of Effectiveness of Principle of Check and Balance in USA
মার্কিন শাসনব্যবস্থায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগসমূহের মধ্যে পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতিকে যথেষ্ট আগ্রহের সাথে প্রয়োগ করা হলেও সংবিধানে এ নীতি সংযোজনের মুখ্য উদ্দেশ্য বাস্তবে সার্থক হয়নি। কেননা এই নীতির প্রয়োগের ফলে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা যায় নি। এই নীতির প্রয়োগের ফলে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভাগের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে কারণে মার্কিন সংবিধান বলবৎ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
ক. শাসন বিভাগের উপর আইন বিভাগের আধিপত্য : মার্কিন শাসনব্যবস্থায় আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় নি। অনেক সময় আইন বিভাগ শাসন বিভাগের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করেছে, আবার কখনো কখনো শাসন বিভাগ আইন বিভাগের উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। যে যে ক্ষেত্রে শাসন বিভাগের উপর আইন বিভাগ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে সেগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো :
ও মার্কিন রাষ্ট্রপতির বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রস্তাব সিনেট অনুমোদন না করে প্রত্যাখ্যান করেছে। রাষ্ট্রপতি কার্টার ভারতকে আণবিক জ্বালানি সরবরাহের ব্যাপারে সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু সিনেট রাষ্ট্রপতির এই প্রস্তাবকে অনুমোদন করেনি।
গু সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি রাষ্ট্রপতির পররাষ্ট্র বিষয়ক অনেক সিদ্ধান্তকে প্রতিরোধ করেছে।
খ. আইন বিভাগের উপর শাসন বিভাগের আধিপত্য । মার্কিন শাসনব্যবস্থায় কোনো কোনো সময় শাসন বিভাগ আইন বিভাগের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করেছে। রাষ্ট্রপতি আইসেনহাওয়ার এর সময় শাসন বিভাগ আইন বিভাগের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করেছে। অ্যালেন পটার (Allen Potter )- এর মতানুসারে জাতীয় সংকটের থাকালে মার্কিন কারাস রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সহযোগিতা করে । প্রকৃত প্রস্তাবে মার্কিন শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণকে সুসংহত করার পশ্চাতে কতগুলো কারণ বিদ্যমান। এই সমস্ত কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মার্কিন রাজনীতিতে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দাপট, মার্কিন সমাজব্যবস্থার বহুমুখি সমস্যা, শক্তিশালী কেন্দ্রিয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা, মার্কিন কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে পটপরিবর্তন প্রভৃতি। এই সমস্ত কারণের জন্য রাষ্ট্রপতি কারাসের উপর আদিপত্য করার সুযোগ ও ক্ষমতা লাভ করেছে। ফলে সাংবিধানিক, রাজনৈতিক ও তারুরি ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রপতি তাঁর ক্ষমতার উপর আরোপিত কোনো কোনো সাংবিধানিক বাধানিষেধ অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। নিম্নে কংগ্রেস তথা আইনসভার উপর মার্কিন রাষ্ট্রপতি তথা শাসন বিভাগের আধিপত্যের দিকসমূহ তুলে ধরা হলো :
মার্কিন রাষ্ট্রপতি তাঁর স্বতন্ত্র সাংবিধানিক অবস্থান ও ক্ষমতাবলে কংগ্রেসের অনুমোদন গ্রহণ করা তো দূরের কথা, এমনকি কংগ্রেসের সাথে পরামর্শ না করেই বিভিন্ন নীতি গ্রহণ ও কার্যকরী করতে সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছেন। যেমন- রাষ্ট্রপতি অনেক বৈদেশিক চুক্তিকে ‘শাসন বিভাগীয় চুক্তি’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে এদের বিষয়ে কংগ্রেসের অনুমোদন গ্রহণের বিধানকে এড়িয়ে যান ।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন উচ্চ সরকারি পদসমূহে নিয়োগ প্রদান করেন। রাষ্ট্রপতির এসকল নিয়োগকে সংক্রান্ত বিষয়ে সিনেট সাধারণত প্রত্যাখান করেন না ।
মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে অভিসংশন বা ইমপিচমেন্ট (Impeachment)- এর মাধ্যমে অপসারণ করার পদ্ধতি এতই কঠিন যে, তিনি কদাচিৎই এ ব্যাপারে পরোয়া করেন না ।
অস্টিন র্যানী উল্লেখ করেছেন, “মার্কিন রাষ্ট্রপতি তাঁর নিজস্ব নির্বাহী ক্ষমতা বলে ঘোষণা, নির্দেশ, অধ্যাদেশ, বিধিবিধান ও আদেশ জারি করে আইন প্রণয়ন করতে পারেন।”
সংকটকালীন অবস্থায় কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির নেতৃত্ব স্বীকার করে। ইন্দোচীন সংকট (১৯৫৪)-এর সময় রাষ্ট্রপতি আইসেনহাওয়ার কংগ্রেসের সমর্থন পেয়েছিল। তাছাড়া ১৯৬১ সালে রাশিয়া ইউ-২ গোয়েন্দা বিমান দুর্ঘটনায় কেনেডি এবং ভিয়েতনাম সংকটে নিক্সন কংগ্রেসের নিকট থেকে সহযোগিতা পেয়েছিল ।
গ. বিচার বিভাগের প্রাধান্য বা আধিপত্য : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় বিচার বিভাগও প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছে। বিচার বিভাগের আইন ও প্রশাসনিক নির্দেশের বৈধতা বিচারের ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে তার ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করেছে। বিচার বিভাগের ‘অনুমিত ক্ষমতার তত্ত্ব’ (Doctrine of Implied Powers) শাসন ও আইন বিভাগের উপর বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। বস্তুত সুপ্রিমকোর্ট নিজেকে মার্কিন সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। বিচার বিভাগের এই আধিপত্য এক ধরনের স্বেচ্ছাচারের নামান্তর মাত্র। আইন ও শাসন বিভাগ বিচার বিভাগের স্বেচ্ছাচার প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে। বিচার বিভাগ যেভাবে নিজের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছে তা নিম্নরূপ :
৩ মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট কংগ্রেস প্রণীত আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করে এসকল আইনকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে। বিচারপতি মার্শাল (Marshal) বলেছেন, “It is emphatically the province and duty of the judicial department to say what the law is.”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিমকোর্ট হলো সংবিধানের চরম ব্যাখ্যাকারক। সংবিধানের ব্যাখ্যাকারক হিসেবে সুপ্রিমকোর্ট গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী। সুপ্রিমকোর্ট প্রদত্ত সংবিধানের ব্যাখ্যাই হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চরম সাংবিধানিক আইন। সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা সম্পর্কে বিচারপতি হিউজেস (Hughes) মন্তব্য করেন যে, “We are under the constitution, but the constitution is what the judges say it is.”
সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা ও প্রভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য কংগ্রেস আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির সম্মতিসহ বিচারপতির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে। রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট ১৯৩৭ সালে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। রুজভেল্টের ‘নিউ ডীল নীতি’ (New Deal Policy)-কে বাস্তবে রূপায়িত করার উদ্দেশ্যে কংগ্রেস প্রণীত বহু বিলকে সুপ্রিমকোর্ট অবৈধ বলে বাতিল করে দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট বিচার বিভাগের সংস্কার সাধনের জন্য সিনেটে একটি বিল উত্থাপন করেন। এ বিলে ৭০ বছর বয়স্ক প্রত্যেক বিচারপতির জন্য একজন বিকল্প বিচারপতি নিয়োগের দাবি পেশ করা হয়। কিন্তু সিনেটের বিচার সংক্রান্ত কমিটি এই বিলের বিরুদ্ধে মতামত দেয় ।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মার্কিন সংবিধানে সংযোজিত ক্ষমতার পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি বাস্তবে খুব একটি ফলপ্রসূ হয় নি। এ নীতির প্রয়োগের ফলে অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভাগের আধিপত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাছাড়া এ কৌশল বা নীতির মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন বিভাগসমূহের ক্ষমতার ভারসাম্যও রক্ষা করা যায় নি । মার্কিন সংবিধান কার্যকরের কয়েক বছরের মধ্যেই এ নীতির কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি একটি অপূর্ব সাংবিধানিক ব্যবস্থা বলে স্বীকৃতি লাভ করেছে।