ব্রিটিশ সংবিধান ও মার্কিন সংবিধানের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা

ব্রিটিশ সংবিধান মার্কিন সংবিধানের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা

Comparative discussion between the Constitution of UK & USA

সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ ও মার্কিন সংবিধানের প্রভাব গোটা বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত। এতদসত্ত্বেও উভয় দেশের সংবিধানের মধ্যে তুলনা করলে সাদৃশ্যের পাশাপাশি বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে ব্রিটিশ ও মার্কিন সংবিধানের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করা হলো :

সাদৃশ্যসমূহ Similarities

ব্রিটিশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করলে যে সমস্ত সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয় সেগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো :

ক. ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে : ব্রিটিশ ও মার্কিন সংবিধান উভয়েই ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করাই হচ্ছে উভয় সংবিধানের প্রধান লক্ষ্য। ব্রিটেনে আইনের অনুশাসন (Rule of Law) এর সাহায্যে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লিখিত সংবিধানে সুপ্রিমকোর্ট ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগগুলোতে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ দ্বারা ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

খ. রাষ্ট্রপ্রধান মনোনয়ন: ব্রিটেনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত, এখানে রাজা রাজত্ব করেন, কিন্তু শাসন করেন না। রাজার যথেষ্ট মর্যাদা ও প্রতিপত্তি থাকলেও প্রকৃত ক্ষমতা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বংশানুক্রমিক কোনো রাজা না থাকলেও নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি রাজার স্থান পূরণ করেছে। ব্রিটেনের রাজার ন্যায় মার্কিন রাষ্ট্রপতিও রাষ্ট্রের প্রধান।

গ. আইনসভায় রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষণ। ব্রিটেনের রাজা পার্লামেন্টের বার্ষিক অধিবেশনের প্রারম্ভে দেশের নানাবিধ সমস্যা ও এগুলোর সমাধান সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। মার্কিন সংবিধানেও অনুরূপ ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়। মার্কিন রাষ্ট্রপতিও কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনের প্রারম্ভে কংগ্রেস সভায় তাঁর লিখিত বাণী প্রেরণ করে জাতীয় সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা ও নির্দেশ দান করতে পারেন ।

ঘ. প্রথাগত বিধানের ক্ষেত্রে মার্কিন সংবিধান মূলত লিখিত হলেও এ সংবিধানে ব্রিটিশ সংবিধানের ন্যায় মার্কিন সংবিধানের কয়েকটি অংশ প্রথাগত বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত। ফলে বলা যায় উভয় দেশের কেবিনেটই এই প্রথাগত বিধানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আবার কালক্রমে উভয় দেশেই এই প্রথাগত বিধানের কতকগুলোকে প্রয়োজন অনুসারে আইনে পরিণত করা হয়েছে।

ঙ. বিচারালয়ের প্রভাব : শুধু প্রথাগত বিধান নয়, মার্কিন ও ব্রিটিশ উভয় সংবিধানই প্রভূত পরিমাণে বিচারালয়ের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তের সাহায্যে পুষ্ট হয়েছে।

চ. পার্লামেন্টের গঠন কাঠামোর ক্ষেত্রে : ব্রিটেনের ন্যায় মার্কিন সংবিধান দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন করে। ব্রিটেনের তৎকালীন উচ্চকক্ষ লর্ডসভা যে ক্ষমতা, ঐতিহ্য ও মর্যাদার অধিকারী ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চকক্ষ সিনেটকেও অনুরূপ সমমর্যাদার অধিকারী করে গঠন করা হয়েছিল।

ছ. প্রতিনিধিত্বশীলতার ক্ষেত্রে : ব্রিটিশ ও মার্কিন উভয় সংবিধানই উদারনৈতিক গণতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। উভয় সংবিধানেই প্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থার বিধান করা হয় ।

বৈসাদৃশ্যসমূহ  Dissimilarities

ব্রিটিশ সংবিধান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে উপরিউক্ত সাদৃশ্যসমূহের পাশাপাশি নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে ব্যাপক পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্যও পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :

ক. উৎপত্তিগত প্রকৃতির ক্ষেত্রে : ব্রিটিশ সংবিধান কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংসদ বা কনভেনশন কর্তৃক আকস্মিকভাবে একদিনে রচিত বা গৃহীত হয়নি, বরং ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে জৈব প্রক্রিয়ার মতো এ সংবিধান গড়ে উঠেছে ।

অপরদিকে, ১৭৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ফিলাডেলফিয়া সম্মেলনে মার্কিন সংবিধান গৃহীত হয় ।

খ. সংবিধান লিপিবদ্ধকরণের ক্ষেত্রে : ব্রটেনের সংবিধান মূলত অলিখিত। ব্রিটিশ সংবিধান অলিখিত সংবিধানের একমাত্র আদর্শ দৃষ্টান্ত বহন করে। অর্থাৎ, ব্রিটেনে এমন কোনো একক দলিল বা দলিল সমষ্টি নেই, যা ঐ দেশের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত সকল গুরুত্বপূর্ণ বিধান নির্দেশ করে। বরং ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত বিধিবিধান বিভিন্ন উৎসে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বিদ্যমান। তবে অলিখিত হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটেনের সংবিধানে বিভিন্ন সনদ বা চুক্তির বিষয়, বিধিবদ্ধ আইন, বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত প্রভৃতি লিখিত অবস্থায় আছে ।

অপরদিকে, মার্কিন সংবিধান বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন লিখিত সংবিধান। মার্কিন সংবিধানে রাষ্ট্রের মৌলিক বিধানাবলি সংযোজিত আছে। তবে লিখিত হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন সংবিধানের কিছু কিছু বিষয় অলিখিত অবস্থায় আছে। যেমন- শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি ও বিচারালয়ের রায়, রাজনৈতিক দলব্যবস্থা, রাষ্ট্রপতির কেবিনেট ব্যবস্থা, রাষ্ট্রপতির প্রত্যক্ষ নির্বাচন ইত্যাদি।

গ. সংবিধান সংশোধন পদ্ধতির ক্ষেত্রে : ব্রিটিশ সংবিধান সুপরিবর্তনীয়। কেননা, ব্রিটিশ সংবিধান সংশোধনের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োজন হয় না বরং ব্রিটিশ সংবিধান সাধারণ আইনের ন্যায় পার্লামেন্টের দ্বারা সংশোধিত হতে পারে।

অপরদিকে, মার্কিন সংবিধান হলো জটিল প্রকৃতির সংবিধান। যে কারণে এটিকে সাধারণ আইন প্রণয়নের ন্যায় সংশোধন করা সম্ভব হয় না, বরং এক বিশেষ ও জটিল পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রিয় আইনসভা কংগ্রেস একক প্রচেষ্টায় সংবিধান সংশোধন করতে পারে না, বরং এক্ষেত্রে রাজ্যসমূহের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হয়। মার্কিন সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় হওয়ায় বিগত দু’শ বছরের অধিক সময়ের মধ্যে কেবলমাত্র ২৬ বার সংশোধিত হয়েছে।

ঘ. সরকার পদ্ধতির ক্ষেত্রে : ব্রিটেনে সাংবিধানিকভাবে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান বিধায় ব্রিটেনে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সেদেশের পার্লামেন্ট।

অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চূড়ান্ত ক্ষমতা সেদেশের রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত থাকে ।

ঙ. শাসনব্যবস্থার কাঠামোগত প্রকৃতির ক্ষেত্রে : উত্তর আয়ারল্যান্ডে স্বতন্ত্র পার্লামেন্টের অস্তিত্ব সত্ত্বেও ব্রিটিশ সংবিধান অনুসারে ব্রিটেনে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। ব্রিটেনে সকল ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে কেন্দ্রিয় সরকারের হাতেই ন্যস্ত। অপরদিকে, সংবিধান অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সংবিধান মতে কেন্দ্রিয় ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। কোনো সরকারই অপর সরকারের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

চ. রাজতন্ত্র প্রজাতন্ত্র বিচারে পার্থক্য : ব্রিটেনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র বিদ্যমান আছে। সেখানে রাজা বা রানীই তত্ত্বগত বিচারে রাষ্ট্রের প্রধান । যদিও বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা শাসন পরিচালনা করেন ।

অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাংবিধানিকভাবে প্রজাতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। সেখানে রাষ্ট্রপতি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানের ভূমিকা পালন করেন।

ছ. ‘কেবিনেট’-এর জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে : ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন কেবিনেট পার্লামেন্টের নিকট দায়ী থেকে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারালে কেবিনেটকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে; নতুবা নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।

অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেবিনেটের অবস্থান বিপরীতমুখি। মার্কিন কেবিনেট মূলত রাষ্ট্রপতির অধস্তন কর্মচারী মাত্র। যে কারণে মার্কিন কেবিনেটকে আইনসভার নিকট জবাবদিহি না করে রাষ্ট্রপতির নিকট জবাবদিহি করতে হয়।

জ. সরকার প্রধানের জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে : ব্রিটেনে রাষ্ট্রপ্রধান রানী হলেও সরকার প্রধান হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীকে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত আইনসভার নিকট জবাবদিহিতা করতে হয় । প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল আইনসভার আস্থার উপর নির্ভর করে। প্রধানমন্ত্রী যদি আইনসভার আস্থা হারান তবে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়।

কিন্তু বিপরীতে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান। তিনি সাংবিধানিকভাবে আইনসভার নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত থেকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য স্বপদে বহাল থেকে নিজের উপর অর্পিত নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইনসভার নিকট দায়ী নহেন এবং তাঁর কার্যকাল আইনসভার আস্থার উপর নির্ভর করে না ।

ঝ. নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি নিজের মতো করে প্রশাসনের উচ্চ পদসমূহে নিয়োগ দান করেন, যাকে ‘Spoil System’ বলা হয়। কিন্তু ব্রিটেনে এ ব্যবস্থার অস্তিত্ব কোনো দিনও ছিল না, বর্তমানেও নেই ।

ঞ. সংবিধানের প্রাধান্যের ক্ষেত্রে : ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত হওয়ার দরুন শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির উপর ভিত্তি করেই সে দেশের সংবিধানের কাঠামো স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রিটেনের আদালতে এগুলো বিশেষভাবে বিবেচিত না হলেও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের গুরুত্ব অপরিসীম।

পক্ষান্তরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে কতিপয় রীতিনীতি থাকলেও এগুলো প্রধান বলে বিবেচিত হয় না। যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানের প্রাধান্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এছাড়া সংবিধানের ৬নং ধারায় সাংবিধানকে ‘রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ‘আইন’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

ট. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ক্ষেত্রে: ব্রিটেনের সংবিধানে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ না হয়ে বরং ক্ষমতার সংমিশ্রণ ঘটেছে। এ নীতির অর্থ হলো রাজা বা রানী অবশ্যই ও সর্বদা কেবিনেটের পরামর্শ গ্রহণ করবেন এবং কেবিনেট? অবশ্যই সর্বদাই কমন্সসভার সমর্থন ভোগ করবে। কেবিনেট সদস্যগণকে অবশ্যই পার্লামেন্ট সদস্য হতে হবে। যে কারণে কেবিনেটকে কার্যত পার্লামেন্টের কমিটি বিশেষও বলা চলে। ব্রিটেনের আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে কোনো অবস্থাতেই দীর্ঘকাল যাবৎ মতানৈক্য চলতে পারে না ।

পক্ষান্তরে, মার্কিন সংবিধানে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির আওতায় সরকারি ক্ষমতাকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের হাতে পৃথকভাবে ন্যস্ত করা হয়েছে। প্রত্যেক বিভাগই নিজ নিজ ক্ষমতা ভোগ করার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করে। এক বিভাগের কর্মকর্তাগণ অপর বিভাগের পদে আসীন হতে পারেন না।

বার্নস ও অন্যান্য লেখক (Burns & Others) মন্তব্য করেন, “ব্রিটিশ ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ও দায়িত্ব আইনসভার হাতে কেন্দ্রিভূত করা হয়; আর মার্কিন ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ও দায়িত্ব সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়।”  ব্রিটিশ সংবিধান ও মার্কিন সংবিধানের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা  

ঠ. ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ভারসাম্য নীতির ক্ষেত্রে পার্থক্য : মার্কিন সংবিধানে স্পষ্টতই “ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি” এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে করে এক বিভাগ অপর বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সমগ্র শাসনব্যবস্থার ভারসাম্য বজায় থাকে। যেমন: মার্কিন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত আইনে ভেটো প্রয়োগ করতে পারেন, আবার কংগ্রেসও রাষ্ট্রপতিকে ইমপিচমেন্টের মাধ্যমে অপসারণ করতে পারে ।

অপরদিকে, প্রত্যেক উন্নত সংবিধানের ন্যায় ব্রিটিশ সংবিধানেও ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি বজায় থাকলে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় স্পষ্ট নয়। যেমন: ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্ট কর্তৃক গৃহীত আইনে ভেটো প্রয়োগ করতে পারেন না। ড. পার্লামেন্টের কাঠামো ও ক্ষমতা চর্চার ক্ষেত্রে : ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশেই দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বজায় থাকলেও দু’টি দেশের আইনসভার কক্ষগুলোর ক্ষমতার মধ্যে যথেষ্ট তারতম্য লক্ষ করা যায়। যুক্তরাজ্যে ইতিহাসের ধারায় পার্লামেন্টের উচ্চক্ষ লর্ডসভা প্রায় ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে এবং নিম্নকক্ষ কমন্সসভাই বর্তমানে পার্লামেন্টের প্রায় সমগ্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছে।

অপরদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা কংগ্রেসের উভয় কক্ষ-প্রতিনিধিসভা ও সিনেট তাদের সাংবিধানিক ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। কোনো বিল আইনে পরিণত হলে তাতে অবশ্যই উভয় কক্ষের সম্মতি থাকতে হবে। ফলে এক কক্ষ অপর কক্ষের উপর বাধা হিসেবে কাজ করে।

ঢ. পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে : ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। কেননা, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ইচ্ছেমতো যে কোনো আইন তৈরি করতে পারে এবং এর ক্ষমতার উপর আইনগত কোনো বাধা আরোপিত নেই । ব্রিটেনে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে ব্রিটেনে কোনো আদালতই পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত কোনো আইনকে সংবিধান পরিপন্থী বলে বাতিল ঘোষণা করতে পারে না ।

অপরদিকে, মার্কিন কংগ্রেস কেবলমাত্র সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাই প্রয়োগ করতে পারে। ‘বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা’র বিষয়টি মার্কিন সংবিধানে স্পষ্টত উল্লেখ না থাকলেও এটি সেখানকার সাংবিধানিক ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত ও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক স্বাক্ষরিত কোনো আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বিচার করার এবং একে ‘সংবিধান পরিপন্থী’ ও ‘বাতিল’ বলে ঘোষণা করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে।

ন. বিচার বিভাগীয় ক্ষমতার ক্ষেত্রে : মার্কিন বিচার বিভাগের ন্যায় ব্রিটেনের বিচার বিভাগ এত শক্তিশালী নয় । সুপ্রিম কোর্টই মার্কিন সংবিধানের রক্ষক ও ব্যাখ্যাকর্তা।

অপরদিকে, ব্রিটিশ বিচার বিভাগ পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের কারণে দুর্বল বিচার বিভাগ বলে সমালোচিত হয়ে আসছে। ত. নাগরিকতার ক্ষেত্রে : ব্রিটেনের নাগরিকগণ কেবলমাত্র কেন্দ্রিয় সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু মার্কিন সংবিধান অনুসারে সেদেশের নাগরিকগণ একাধারে কেন্দ্রিয় ও অঙ্গরাজ্য সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে। অর্থাৎ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্বি-নাগরিকত্ব বিদ্যমান ।

 নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে : ‘অধিকারের বিল’ (Bill of Rights) নামে সাংবিধানিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার স্বীকৃত। কিন্তু ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় এ ধরনের কোনো রীতিনীতির কথা উল্লেখ নেই।

দ. উপাধি বণ্টনের ক্ষেত্রে : ব্রিটেনের রাজা-রানী সাংবিধানিকভাবে উপাধি বন্টনের অধিকার ভোগ করেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধান মোতাবেক সর্বপ্রকার উপাধি গ্রহণ ও বণ্টন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ

খ. গণতন্ত্রের প্রকৃতি সংক্রান্ত : রাজতন্ত্রের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও গ্রেট ব্রিটেনে পরোক্ষ গণতন্ত্র বর্তমান। মার্কিন শাসনব্যবস্থায় প্রধানত পরোক্ষ গণতন্ত্র প্রবর্তিত হলেও এক-তৃতীয়াংশ অঙ্গরাজ্যে এখনও প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বিদ্যমান। তদুপরি সব মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বর্তমান বিশ্বে আদর্শ মডেল তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ/ সুযোগ নেই ।

পরিশেষে বলা যায় যে, মার্কিন ও ব্রিটিশ সংবিধানের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য নেহায়েতই তত্ত্বগত। বাস্তবে উভয় দেশের সংবিধানের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। কেননা, উভয় দেশের সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে অভিজাত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার প্রেরণা বা উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। তবে একথা বলা যায় যে, ব্রিটেনে রাজ্য সমেত পার্লামেন্টের প্রাধান্য স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধানই প্রধান।

Leave a Reply