ব্রিটিশ সংবিধানের প্রকৃতি Nature of British Constitution
ব্রিটিশ সংবিধানের প্রকৃতি নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য বিদ্যমান। অনেক চিন্তাবিদদের মতে ব্রিটেনে কোনো সংবিধান নেই। আবার অনেকে এই ধারণার প্রতিবাদ করে বিরুদ্ধ মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তাঁদের মতে ব্রিটেনের সংবিধান আছে এবং এই সংবিধান হলো অন্যতম প্রাচীন সংবিধান।
ক. ব্রিটিশ সংবিধানের অস্তিত্ব সম্পর্কে মতপার্থক্য : জর্জ বার্নার্ড শ (George Bernard Shaw), টকভিল (Alexis de Tocquville), টমাস পেইন (Thomas Paine) প্রমুখ চিন্তাবিদের মতে, ব্রিটিশ সংবিধানের কোনো অস্তিত্ব নেই। টকভিল এর মতে, “ইংল্যান্ডের সংবিধান বলতে কিছুই নেই” (In England the constitution does not exists)। বার্নার্ড শ’র মতে, “আমাদের নাকি সংবিধান আছে, কিন্তু তা যে কী জিনিস কেউ জানে না, কারণ কোথাও তা লিখিত অবস্থায় নেই।” এডমন্ড বার্ক (Edmund Burke) ফরাসি বিপ্লবের সমালোচনা করে ব্রিটিশ সংবিধানের প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলে টমাস পেইন (Thomas Paine) বলেছিলেন, “মি. বার্ক কি ব্রিটিশ সংবিধান নামক কিছু দেখাতে পারেন? যদি তিনি না পারেন, তাহলে সঙ্গতভাবেই আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, এ সম্বন্ধে যাই বলা হোক না কেন, ব্রিটেনের সংবিধান নেই বা কখনই ছিল না,” (Can Mr. Burke produce the British Constittution ? If he cannot, we may fairly conclude that though it has been so much talked about no such thing as a constitution exists or ever did exist.) কিন্তু জেনিংস ( Jennings), মুনরো (Munro) প্রমুখ সংবিধান বিশেষজ্ঞগণ উপরিউক্ত সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন না। মুনরো (Munro)-এর মতে, ব্রিটেনে সংবিধানের অস্তিত্ব সম্পর্কে এই মতপার্থকের মূলে আছে সংবিধান কাকে বলে সেই বিষয়ে মতবিরোধ। সাধারণত দুটি অর্থে সংবিধান কথাটি ব্যবহার করা হয়, যথা—সংকীর্ণ ও ব্যাপক ।
খ. সংকীর্ণ অর্থে ব্রিটেনে সংবিধান নেই : সংকীর্ণ অর্থে সংবিধান হলো একটি দেশের সেসব লিখিত মৌলিক আইন কানুন, যেগুলো দ্বারা সরকার ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি এবং রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকদের সম্পর্ক প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়। এরূপ সংবিধান একটি দেশের গণপরিষদ (Constituent Assembly) বা কনভেনশন (Convention) কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত ও ঘোষিত হয়। এ ধরনের সংবিধান পরিবর্তনের জন্য সাধারণ আইন প্রণয়নের পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা যায় না। এরূপ সংবিধান পরিবর্তনের জন্য বিশেষ পদ্ধতি (Special Procedure) অনুসরণ করতে হয়। এ ধরনের সংবিধানের রচনাকাল এবং তাকে কার্যকর করার দিন স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। সুতরাং সংকীর্ণ অর্থে ব্রিটেনে কোনো সংবিধান নেই একথা বলা যায় ৷
গ. ব্যাপক অর্থে ব্রিটেনে সংবিধান বর্তমান : আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সংকীর্ণ অর্থে সংবিধানকে গ্রহণ করার পক্ষপাতি নন । তাঁরা ব্যাপক অর্থে সংবিধানকে গ্রহণ করে থাকেন। ব্যাপক অর্থে সংবিধান বলতে কোনো দেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী লিখিত ও অলিখিত নিয়মকানুনের সমষ্টিকে বোঝায়। লিখিত নিয়মকানুন বলতে আইনকে বোঝায়। আর অলিখিত নিয়মকানুন বলতে প্রথা, প্রচলিত রীতিনীতি ও আচার ব্যবহারকে বোঝায়। বস্তুত ব্রিটিশ সংবিধানের একাংশ যেমন সাংবিধানিক আইনসমূহের ভিত্তিতে গঠিত, তেমনি অপরাংশ গড়ে উঠেছে সাংবিধানিক প্রথাসমূহের ভিত্তিতে। সুতরাং ব্যাপক অর্থে ব্রিটেনে সংবিধান আছে। এ প্রসঙ্গে মুনরো এবং আয়ার্স্ট বলেছেন, ব্রিটেনের সংবিধান হলো প্রতিষ্ঠান, নীতি ও আচার ব্যবহারসমূহের : এক জটিল সংমিশ্রণ। এই সংবিধানকে সনদ ও বিধিবদ্ধ আইন, বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত, প্রথাগত আইন, নজির, প্রথা এবং সুদীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত রীতিনীতিসমূহের সমষ্টি বলা যেতে পারে। এটি একটি মাত্র দলিল নয়; বরং অসংখ্য দলিলের সমষ্টি। একটি মাত্র উৎস থেকে এই সংবিধানের সৃষ্টি হয়নি। বহু উৎস থেকে এই সংবিধানের উৎপত্তি হয়েছে। এই সংবিধানকে সম্পূর্ণ বলা যায় না; বরং ক্রমবর্ধমান বলা যেতে পারে। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেছেন, ব্রিটিশ সংবিধান এমন কতকগুলো নজিরের সমষ্টি, যা সুদীর্ঘকাল ধরে মানুষের স্মৃতিতে প্রবাহিত হয়ে আসছে অথবা লিপিবদ্ধ হয়েছে।
ঘ. আইভর জেনিংস (Ivor Jennings)-এর মতে, লিখিত সংবিধান হলো শাসনকার্য পরিচালনার একটি কাঠামো মাত্র । বিভিন্ন বিধি, নিয়ম, রীতিনীতি ও প্রথা পদ্ধতির মাধ্যমে এ কাঠামো পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোনো লিখিত সংবিধানই সরকারের সকল প্রতিষ্ঠানের বিধি নিয়ম সংকলন করে না। ব্রিটেনে প্রথাসমূহের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সাংবিধানিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ম নীতিগুলোর উদ্ভব হয়েছে। এই সকল সাংবিধানিক নীতি নির্ধারণকারী প্রথাসমূহ বর্তমানে আইনের মাধ্যমেও বিন্যস্ত হয়েছে। আবার কিছু কিছু প্রথা বিচার বিভাগীয় স্বীকৃতি লাভের মাধ্যমে প্রথাগত আইনে পরিণত হয়েছে।
ঙ. ব্রিটিশ সংবিধান ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের ফল : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, ভারত, বাংলাদেশ প্রভৃতি দেশের মতো কোনো লিখিত সংবিধান ব্রিটেনে না থাকলেও লিখিত সংবিধান যেসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে সেই সব প্রতিষ্ঠান এখানেও বহু বছর ধরে গড়ে উঠেছে। যুগের পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি বিধান করে সেগুলোও পরিবর্ধিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আইভর জেনিংস (Ivor Jennings)-এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, “যদি সংবিধান বলতে লিখিত দলিলকে না বুঝিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বোঝায়, তাহলে বলা যায় যে, ব্রিটিশ সংবিধান একদিনে তৈরি হয়নি-এটি গড়ে উঠেছে এবং এর লিখিত কোনো দলিল নেই।” (If a constitution consists of institutions and not the paper that describes them the British constitution has not been made, but has grown and there is no paper.)
হারতে ও ব্যাথার (J. Harvey and L Bather) এর মতে, ইংরেজ জাতি কোনো নির্দিষ্ট দলিলকে সংবিধান হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন না বলেই ধরে নেওয়া ঠিক হবে না যে, ব্রিটিশ সংবিধানের অস্তিত্ব নেই। তাঁরা আরও বলেছেন যে, “কোনো পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ সংবিধানের বিন্যাস সাধন করা হয়নি। প্রয়োজন এবং পরিবর্তিত অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে কয়েক শতাব্দি ধরে এই সংবিধান বর্তমান রূপ লাভ করেছে।” (The British constitution has not been shaped to a preconceived plan; it has simply evolved over the centuries by responding to changing needs and circumstances) [J. Harvey and L. Bather, The British Constitution p-19]
চ. উইলিয়াম অ্যানসন (William Anson)- এর মতে, ব্রিটিশ সংবিধান হলো এমন একটি পূর্বপরিকল্পনাহীন সৌধ, যার মালিকানা বার বার পরিবর্তিত হয়েছে। এই সংবিধান বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মালিক নিজের প্রয়োজন ও রুচি অনুযায়ী এর পরিবর্তন সাধন করলেও তাদের কেউই এটিকে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করে দিয়ে নিজের পরিকল্পনা মতো গড়ে তোলেন নি।
ছ. কোনো দেশের সংবিধানই পূর্ণাঙ্গ নয় : বস্তুত কোনো দেশের সংবিধানই পূর্ণাঙ্গ নয়। ভারত,
পূর্ণাঙ্গ নয়। ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ কিংবা অন্য কোনো দেশের লিখিত সংবিধান সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গঠন, ক্ষমতা এবং কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণকারী নীতিসমূহ চিরদিনের মতো নির্ধারণ করতে পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান লিখিত হলেও রাষ্ট্রপতির কেবিনেট, দলীয় ব্যবস্থা, সুপ্রিম কোর্টের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার ক্ষমতা ইত্যাদি প্রথাগত বিধানের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে।
জ. ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্রের সমন্বয় ঘটেছে : ব্রিটিশ রাজতন্ত্র একটি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। একবিংশ শতাব্দিতে এসে ব্রিটেনে এখনও রাজতন্ত্র টিকে আছে। ব্রিটেনের সরকারি সকল কাজ রাজার নামেই সম্পাদিত হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ লর্ডসভা অভিজাততন্ত্রের পরিচয় বহন করে। কেননা লর্ডসভা ব্রিটেনের অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকজন নিয়ে গঠিত হয়। তেমনি বর্তমানে প্রিভি কাউন্সিল গঠিত হয় রাজ পরিবারের সদস্য, কেবিনেটের প্রাক্তন ও কিছু বর্তমান সদস্য, ডোমিনিয়নগুলোর প্রধানমন্ত্রীগণ, দু’জন বিশপ এবং বিশিষ্ট অভিজাত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ-কমন্সসভা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠিত হয়। এই সভার সদস্যগণ ব্রিটেনের জনগণের দ্বারা সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর নবগঠিত কমন্সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে কেবিনেট গঠিত হয়। কেবিনেট বা মন্ত্রিসভা সরকারের শাসনকার্য পরিচালনা করে।
পরিশেষে বলা যায়, কোনো একটি দেশের সংবিধান লিখিত হলেই যে তাকে আদর্শ সংবিধান বলা যাবে এমন কোনো কথা নেই। প্রকৃতপক্ষে কোনো দেশের সংবিধানই সম্পূর্ণরূপে লিখিত ও বিধিবদ্ধ নয় এবং থাকা সম্ভব নয়। প্রত্যেক দেশের সংবিধানই লিখিত ও অলিখিত বিধি ও পদ্ধতির সমন্বয়ে সৃষ্টি। এসব কারণে হারভে ও ব্যাথার (Harvey and Bather) মন্তব্য করেছেন, ব্রিটেনের কোনো সংবিধান নেই—এ কথা বলা থেকে ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত বলাই সমীচীন।