Table of Contents
Toggleবিচার বিভাগ The Judiciary
বিচার বিভাগ
The Judiciary
বর্তমান আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের বিভাগসমূহের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো বিচার বিভাগ । বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা ব্যতীত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, যে রাষ্ট্রে এক শ্রেণির নাগরিক অন্য শ্রেণির নাগরিকের উপর অত্যাচার করলেও বিচারালয়ে দণ্ডিত হয় না সে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের অভাব দেখা দেয় ৷ সেই রাষ্ট্রে বিপর্যয় আসন্ন। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের ভূমিকা ব্যতীত সুশীল সমাজের অস্তিত্বও কল্পনা করা যায় না। তবে বিচার বিভাগকে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিভাগ বলা হলেও বিচার বিভাগ রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। যে কারণে অ্যালান বল মনে করেন যে, বিচারপতিদের বিচার ক্ষমতা কখনো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ, ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতাকে নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য।
বিচার বিভাগ The Judiciary
সরকারের যে বিভাগ রাষ্ট্রের সার্বিক বিচার কাজে নিয়োজিত রয়েছে সেই বিভাগকেই বিচার বিভাগ বলা হয়। এটি মূলত ন্যায় বিচারের সুরক্ষায় অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করে ও নিরাপরাধীকে মুক্তি দিয়ে জনগণের অধিকার সুরক্ষা করে ।
১. অধ্যাপক হেনরি সিজউইক (Prof. Henry Sidgwick)-এর মতে, “বিচার বিভাগ হচ্ছে সে বিভাগ যা আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করে ও আইনের প্রয়োগ করে।”
২. মনীষী আলফ্রেড ডানিং (Alfred Dunning)-এর মতে, “বিচার বিভাগ হলো সরকারের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ, যা জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করে এবং এ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রকার রীট জারি করে।”
৩. অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski) বলেন, “বিচার বিভাগ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের অভিভাবক ও চরম ব্যাখ্যাকর্তা।” আর. সি. আগারওয়াল ( R. C. Agarwal)-এর মতে, “The Judiciary is one organ which interpretes the legislative makes law and executive implements.”
৪. রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলোবী (Willoughby)-এর দৃষ্টিতে, “বিচার বিভাগ হলো সরকারের ঐ বিভাগ যে বিভাগ অপরাধীদের শাস্তি প্রদান ও নিরাপরাধীদের মুক্তি দেয়।”
৫. অধ্যাপক গার্নার (Prof. Garner) বলেন, “বিচার বিভাগ হচ্ছে সরকারের অপরিহার্য অঙ্গ, যার অস্তিত্ব ব্যতীত সভ্য রাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না।”
৬. লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce)-এর মতে, “সরকারে বিচারকার্যে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের সমষ্টি হচ্ছে বিচার বিভাগ ।” ৭. মনীষী সেইট (Sait)-এর ভাষায়, “Judiciary is the guardian of the freedom of the people and the
constitution to protect the fundamental rights of the people.”
সুতরাং বলা যায় যে, বিচার বিভাগ হলো সরকারের এমন এক অপরিহার্য অঙ্গ যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরস্থ বিচার সংক্রান্ত যাবতীয় কার্য সম্পাদন করে। যেমন : জনগণের মৌল অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষা, পারস্পরিক কলহ-বিবাদ মীমাংসা প্রভৃতি। আইন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত আইনের পরীক্ষাগার হলো বিচার বিভাগ। একে সংবিধান ও সরকারের অভিভাবক রূপে আখ্যায়িত করা হয় ।
বিচার বিভাগের সংগঠন Formation of the Judiciary
নিরপেক্ষ ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচার বিভাগের সুসংগঠন অপরিহার্য। প্রায় সকল দেশের বিচার বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে সামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। বিচার বিভাগের সাধারণ কাঠামো নিম্নে তুলে ধরা হলো
১. নিম্ন আদালত (Lower Level Court) : নাগরিকদের অধিকার, অপরাধ, বিরোধ সংক্রান্ত মামলা নিম্ন স্তরের আদালতে সম্পন্ন করা হয়। আর নিম্নস্তরের আদালতকে সাধারণত দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যথা : ফৌজদারি আদালত ও দেওয়ানি আদালত। এক্ষেত্রে ফৌজদারি আদালতে অপরাধ সংক্রান্ত এবং দেওয়ানি আদালতে সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলার বিচার করা হয়ে থাকে।
২. মধ্য স্তরের আদালত (Middle Level Court) : বিচার বিভাগের অধঃস্তন আদালতের উপরের আদালত হলো মধ্যম স্তরের আদালত। মধ্যম স্তরের আদালত সাধারণত নিম্ন আদালতের রায় পুনর্বিবেচনা করে থাকে। আবার বড় বড় দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচারও করে থাকে মধ্য স্তরের আদালত ।
৩. উচ্চ আদালত (Higher Level Court) : দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে মূলত উচ্চ আদালত বলা হয়। এ আদালত মধ্যম স্তরের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি গ্রহণ ও বিচার করা এবং রাষ্ট্রের সাংবিধানিক সমস্যা সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে গুরুত্ব সহকারে বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। উচ্চ আদালতের সাধারণত দু’টি বিভাগ থাকে! যথা— হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ ।
বিচারকদের নিয়োগ পদ্ধতি Method of Appointment of Justice
মূলত তিনটি পদ্ধতিতে বিচারকগণ নিয়োগ লাভ করে থাকেন। নিম্নে পদ্ধতি তিনটি গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হলো :
১. জনগণ কর্তৃক নির্বাচন : কোনো কোনো দেশে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে বিচারক নিয়োগ করা হয়ে থাকে। যেমন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু অঙ্গরাজ্যে, সুইজারল্যান্ডের কয়েকটি ক্যান্টনে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে গণআদালতের বিচারকগণ গণনির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। কিন্তু অধ্যাপক লাস্কির (Prof. Laski) ন্যায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ বিচারক নিয়োগের এই পদ্ধতিকে সমর্থন করেননি। তিনি বলেন, “Of all the methods of appointment, that of election by the people at ‘large is without execption the worst”- এ পদ্ধতির বিরোধিতার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কারণের উল্লেখ করা যেতে পারে :
ক. বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা বা দক্ষতা সাধারণ জনগণের থাকে না। যে কারণে অধিকাংশ সময়ই জনগণ ভাবাবেগ বা দলীয় প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে অযোগ্য প্রার্থীদের বিচারগতি পদে নির্বাচিত করেন ।
খ. জনগণ কর্তৃক বিচারপতি নিয়োগের ব্যবস্থা থাকলে বিচারপতিগণ সর্বদাই জনগণের সন্তুষ্টি বিধানে বিচারকার্য সম্পাদন করেন ।
গ. কোনো ব্যক্তি জনপ্রিয় হলেই সে সুবিচার পাবে তা বলা যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, জনপ্রিয় ব্যক্তিগণ ভালো রাজনীতিবিদ হয়ে থাকেন কিছু ভালো বিচারক হন না।
ঘ. আধুনিক গণতন্ত্রের অর্থ হলো দলীয় শাসন। বিচারপতিগণকে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হতে হলে কোনো প্রভাবশালী দলের সমর্থনপুষ্ট হতে হবে। ফলে তারা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের কোনো কর্মী, সভ্য বা সমর্থকের অপরাধের পক্ষপাতহীন বিচার করতে সক্ষম হবে না। তবে গণতন্ত্রকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে বিচার বিভাগের উপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। এদিক থেকে জনগণ কর্তৃক বিচারপতিদের নিয়োগের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে। অবশ্য এ পদ্ধতির যে কিছু ত্রুটি-বিচুতি আছে তা অস্বীকার করা যায় যায় না ।
২. আইনসভা কর্তৃক বিচারপতি নিয়োগ : কোনো কোনো দেশে আইনসভার দ্বারা পরোক্ষভাবে বিচারপতি নিয়োগদান বলা হয়। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন, সুইজারল্যান্ড, আলবেনিয়া, বুলগেরিয়া প্রভৃতি দেশে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। আইনসভা কর্তৃক বিচারপতি নিয়োগের এ পদ্ধতিকে অনেকে গণতন্ত্র সম্মত বলে মনে করলেও কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উক্ত পদ্ধতিকে স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার পরিপন্থী বলে মনে করেন। কারণ এরূপ নির্বাচনের ফলে আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মনোনীত ব্যক্তিরা বিচারক পদে নির্বাচিত হন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা সদা-সর্বদা আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য বিচারকার্য পরিচালনা করে থাকেন। ফলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সর্বদা সম্ভব হয় না। অ্যধাপক লাস্কি (Prof. Laski)-এর সমালোচনা করে বলেন, “Election by the Legislature is an undesirable form of appointment” – এ পদ্ধতির বিরোধিতার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত কারণের উল্লেখ করা যেতে পারে :
ক. আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনে বিচারপতিগণ নিয়োগ লাভ করেন বিধায় বিচারপতিদের যোগ্যতা ও ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ থাকে।
খ. আইনসভা কর্তৃক নির্বাচন মূলত দলীয় প্রার্থীর নির্বাচন। বিচারকের জ্ঞান-গরিমা ও আইনের ক্ষেত্রে যোগ্যতা মূল্যায়ন করা হয় না।
গ. এর ফলে দলীয় কার্য ও আইনসভার প্রাধান্য পায়। যা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
৩. শাসন বিভাগ কর্তৃক বিচারপতি নিয়োগ : শাসন বিভাগ কর্তৃক বিচারপতি নিয়োগের পদ্ধতিকে অনেকে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বলে মনে করে থাকেন। কেননা আসন বিভাগ কর্তৃক নিযুক্ত বিচারপতিগণ রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী বা জনমতের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। এ পদ্ধতি অনুসারে সর্বোচ্চ শাসন কর্তৃপক্ষ বিচারপতিদের নিয়োগ করেন। তবে নিয়োগের পূর্বে অন্যান্য বিচারপতি কিংবা বিচারপতিদের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি সংস্থার সঙ্গে তিনি পরামর্শ করে থাকেন। অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski) বিচার বিভাগীয় মন্ত্রীর মনোনয়ন অনুযায়ী বিচারপতি নিয়োগের পক্ষপাতি। তিনি বলেন, “মনোনয়ন দেবার সময় বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত একটি স্থায়ী কমিটির অনুমোদন কাম্য। কেননা, বিচারপতিরাই ভালো জানেন কে যোগ্য এবং কাদের রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা কম।”
তবে এ পদ্ধতি অনুসরণের সময় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। শাসন বিভাগের কার্যে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করা হলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি শাসন বিভাগ নিরপেক্ষ হয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারেন না। তাছাড়া বিভাগীয় কোনো পদে বিংবা কূটনীতিবিদ হিসেবে হিসেবে নিয়োগ করার পথে কোনো বাধা থাকে না। তবে বিচারপতিগণ ভবিষ্যতে এ সরকারের আনুকূল্য লাভের আশায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে সরকারের পক্ষে বিচার কার্য পরিচালনা করতে পারেন। ফলে নির্ভীক ও নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না ৷