প্রথাগত বিধানের শ্রেণিবিভাগ

প্রথাগত বিধানের শ্রেণিবিভাগ

ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় প্রচলিত প্রথাগত বিধানসমূহকে কার্যকরণগত বিচারে প্রধানত চার ভাগে বিভক্ত করা যায়; যথা (ক) রাজা বা রানীর বিশেষাধিকার সম্পর্কিত প্রথাগত বিধান; (খ) কেবিনেট ব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রথাগত বিধান; (গ) পার্লামেন্ট সম্পর্কিত প্রথাগত বিধান এবং (ঘ) কমনওয়েলথ সম্পর্কিত প্রথাগত বিধান। নিম্নে এগুলোর বিশদ আলোচনা করা হলো :

ক. রাজা বা রানীর বিশেষাধিকার সম্পর্কিত প্রথাগত বিধান (Conventions relating to the royal prerogatives) : রাজা বা রানীর বিশেষাধিকার বলতে রাজশক্তির প্রাক্তন স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অবশিষ্টাংশকে বোঝায়। ১৬৮৮ সালের গৌরবময় বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটেনের রাজা বা রানী চরম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এই বিপ্লব সাফল্যমণ্ডিত হওয়ার পর ১৬৮৯ সালে

 অধিকারের বিল (Bill of Rights) গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে পার্লামেন্টের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং রাজশক্তির ক্ষমতা বহুলাংশে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তবুও প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা আইনগতভাবে রাজার হাতেই থেকে যায় ৷ শাসন বিভাগের এই ক্ষমতার সাথে পার্লামেন্টের প্রাধান্যের সামঞ্জস্য সাধনের উদ্দেশ্যে কেবিনেট ব্যবস্থার উৎপত্তি হয়। কেবিনেট ব্যবস্থা চালু হওয়ার ফলে রাজার বিশেষাধিকার প্রয়োগ সম্পর্কে বিশেষ প্রথাগত বিধান গড়ে ওঠে। এ ধরনের কয়েকটি প্রথাগত বিধান হলো :

রোজা বা রানী কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করবেন।

প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাজা বা রানী অন্যান্য মন্ত্রীকে নিয়োগ করবেন।

রাজা বা রানী মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করবেন।

* রাজা বা রানী কেবিনেটের বা মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী পার্লামেন্টের অধিবেশন আহবান করবেন।

ও পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ কর্তৃক গৃহীত বিলে রাজা বা রানী সম্মতি দিতে বাধ্য থাকবেন।

* রাজা বা রানীর অনুমোদন ছাড়া কোনো বিল আইনে পরিণত হয় না। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাজা বা রানী পার্লামেন্ট ভেঙে দিবেন ।

ও নিয়মতান্ত্রিক শাসক রাজা বা রানী রাজনীতির ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। ইত্যাদি ।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ব্রিটিশ রাজা বা রানী তাঁদের ‘বিশেষাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে গড়ে ওঠা প্রথাগত বিধানসমূহ মেনে চললেও মাঝে মঝে এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯০২ সালে লর্ড সলবেরি প্রধানমন্ত্রীর পদ, থেকে পদত্যাগ করার পর থেকেই লর্ডসভার কোনো সদস্যকে রাজা বা রানী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্থায়ীভাবে নিয়োগ করেন নি । কেবল ১৯৬৩ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এই প্রথা উপেক্ষা করে লর্ডসভার সদস্য স্যার এ্যালেক্স ডগলাসে হিউম (Sir Alexander Alec Frederick Douglas Hume)-কে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। পরে অবশ্য হিউম লর্ড উপাধি ত্যাগ করে কমপসভার একটি উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়যুক্ত হন।

খ. কেবিনেট ব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রথাগত বিধান (Conventions related to the cabinet) : ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য হলো কেবিনেট ব্যবস্থা। অথচ ব্রিটিশ কেবিনেটের সাংবিধানিক কিংবা আইনগত কোনো ভিত্তি নেই; তা সম্পূর্ণভাবে প্রথাগত বিধানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। কেবিনেট ব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রথাগত বিধানের মধ্যে মূল প্রথাসমূহ নিম্নরূপ :

কেবিনেট বা মন্ত্রিসভা যৌথভাবে পার্লামেন্টের কাছে দায়িত্বশীল থাকবে।

কমন্সসভার আস্থা হারালে সমগ্র মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হবে।

কেবিনেটের প্রত্যেক মন্ত্রী তাঁর বিভাগ কর্তৃক সম্পাদিত কার্যাবলির জন্য পার্লামেন্ট, বিশেষত কমন্সসভার নিকট ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকবেন ।

ও ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর অবিসংবাদিত প্রাধান্য থাকবে ।

ও প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই কমন্সসভার সদস্য হতে হবে। তিনি হবেন কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ।

ও মন্ত্রীদের পার্লামেন্টের যে কোনো একটি কক্ষের সদস্য হতে হবে।

* পার্লমেন্টের সদস্য নন এমন কোনো ব্যক্তি কেবিনেট-মন্ত্রী নিযুক্ত হলে তাঁকে ৬ মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের যে কোনো কক্ষের সদস্য হতে হবে।

ও পররাষ্ট্র নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে, বিশেষ করে যুদ্ধ ঘোষণা ও শান্তি স্থাপনের ব্যাপারে মন্ত্রিসভাকে পার্লামেন্টের অনুমোদন নিতে হবে, ইত্যাদি।

গ. পার্লামেন্ট সম্পর্কিত প্রথাগত বিধান (Conventions relating to the parliament) : ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কার্যাবলি সম্পাদনের ব্যাপারে অনেক আইন প্রণীত হয়েছে। কিন্তু সেগুলো যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয় না। তাই পার্লামেন্ট এবং তার উভয় কক্ষের কার্যাবলি ও সম্পর্ক প্রথাগত বিধানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এগুলোর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো-

 বছরে অন্তত একবার পার্লামেন্টের অধিবেশন আহ্বান করতে হবে ।

পার্লামেন্টের অধিবেশনের শুরুতে রাজা বা রানী ‘ভাষণ’ দেবেন ।

 েপার্লামেন্টের কর্মসূচি স্থির করার আগে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের নেতার সাথে আলোচনা করবেন ।

 কমন্সসভার স্পিকার দল নিরপেক্ষভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করবেন।

কমাসভার বিতর্কে যাতে সরকারি দল ও বিরোধী দল সমান সুযোগ পায়, স্পীকার সেদিকে লক্ষ রাখবেন । ও পার্লামেন্টের বিভিন্ন কমিটি সমানুপাতিক হারে বিভিন্ন দলের সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত হবে।

অর্থবিল কেবল কম সভায় উত্থাপন করা যাবে।

ও কোনো বিল কম সভায় তিনবার পাঠ হওয়ার পর লর্ডসভায় পাঠাতে হবে।

 লর্ডসভা ও কমথসভার মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে কমন্সসভার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

* লর্ডসভা যখন সর্বোচ্চ আপীল আদালত হিসেবে বিচার কার্য সম্পাদন করবে- তখন ৯ জন আইনজ্ঞ লর্ড বিচারক হিসেবে কাজ করবেন, ইত্যাদি।

ঘ. কমনওয়েলথ সম্পর্কিত প্রথাগত বিধান (Conventions relating to the Commonweath) : এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার যে সকল দেশ এককালে ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল, তাদের নিয়ে কমনওয়েলথ নামক সংস্থা গঠিত। ব্রিটেনের সাথে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সম্পর্ক প্রথাগত বিধানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে ১৯৩১ সালের ওয়েস্টমিনিস্টার আইন (Statute of Westminister)-এর মাধ্যমে পার্লামেন্ট এসব প্রথাগত বিধানের অধিকাংশ বিধিবদ্ধ করেছে। তবু এখনও কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সাঃ সম্পর্ক বিষয়ক কিছু প্রথা বিদ্যমান। এই শ্রেণির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথাগত বিধান হলো :

ও কোনো ডোমিনিয়নের গভর্নর জেনারেল নিয়োগ করার সময় রাজা বা রানী সংশ্লিষ্ট ডোমিনিয়নের প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন।

ও কোনো ডোমিনিয়নের রাজার উত্তরাধিকারী নিয়োগের সময় সংশ্লিষ্ট ডোমিনিয়নের আইনসভার পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

কোনো ডোমিনিয়ন অনুরোধ না করলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তার জন্য কোনো আইন প্রণয়ন করবে না । ডোমিনিয়ন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী গভর্নর জেনারেল কার্যসম্পাদন করবেন।.

ডোমিনিয়নে নিযুক্ত গভর্নর জেনারেল হলেন ব্রিটেনের রাজা বা রানীর প্রতিনিধি, তিনি ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি নন। এজন্য ব্রিটেনের রাজা বা রানী অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের রাজা বা রানী।

কমনওয়েলথভুক্ত দেশুগুলো রাজা বা রানীর সভাপতিত্বে বাৎসরিক অধিবেশনে বসবে ও পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারবে।

কমনওয়েলথের সদস্যপদ ঐচ্ছিক। এজন কমনওয়েলথভুক্ত যে কোনো দেশ স্বেচ্ছায় কমনওয়েলথ ত্যাগ করতে পারবে। ইত্যাদি।

প্রথাগত বিধান মান্য করার কারণ  Reasons of Obeying the Conventions

ব্রিটেনের প্রথাগত বিধানসমূহ আইন নয় এবং আদালত এগুলোকে কার্যকর করার জন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয় না। তা সত্ত্বেও ব্রিটেনে এগুলো শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে মেনে চলা হচ্ছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে প্রথাগত বিধান কেন মান্য করা হয়? এর পিছনে বিভিন্ন কারণ নিহিত। প্রথাগত বিধান মান্য করার কারণসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :

ক. শাস্তির ভয় : আগে মনে করা হতো অপসারণমূলক শাস্তির ভয়ে প্রথাগত বিধান মেনে চলা হয়। কারণ প্রথাগত বিধানসমূহ লঙ্ঘন করলে আইন প্রণয়নকারী সংস্থা শাস্তি প্রদান করতে উদ্যত হবে। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলে ডাইসী প্রমুখ লেখক মনে করেন। ডাইসির মতে, শাস্তির ভয় যদি প্রথাগত বিধান মেনে চলার প্রধান কারণ হয় তাহলে এগুলোকে প্রথাগত বিধান না বলে আইন বলাই যুক্তিসঙ্গত। কারণ আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি পেতে হয়, প্রথাগত বিধান ভঙ্গ করলে নয়।

খ. আইন লঙ্ঘনের ভয় : অধ্যাপক ড্রাইসি (A. V. Diecy) বলেন, প্রথাগত বিধানগুলো লঙ্ঘন করলে চূড়ান্ত পর্যায়ে আইনের সাথে সংঘর্ষ বাধতে পারে। ডাইসির ভাষায়, The breach of these principles and conventions will almost immediately bring the offender into confict with the courts and the law of the land; যেমন—বছরে একবার পার্লামেন্টের অধিবেশন না বসলে বাজেট পাস হবে না। এই প্রথাটি লঙ্ঘন করলে আইনের সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি হবে। পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘিত হবে। সুতরাং আইনের সাথে সংঘর্ষের আশঙ্কায় ব্রিটেনে প্রথাসমূহ মেনে চলা হয়।

গ. জনমতের চাপ : প্রথাগত বিধানসমূহ মান্য করার মূল কারণ হলো ‘জনমতের চাপ’ বলে অনেকে মন্তব্য করেন। অধ্যাপক অগ (Prof. Ogg) বলেন, “প্রথাগত বিধানসমূহ মান্য করার প্রকৃত কারণ হলো জনমতের চাপ। প্রথাগত বিধানসমূহ মেনে চলা হয় কারণ জনমত চায় এগুলো মেনে চলা হোক।” (The real samction behind conventions is the force of public opinion. Conventions are obeyed because the public opinion demand’s that they must be obeyed), ব্রিটেনের জনমত সবসময় প্রথাগত বিধানসমূহ মেনে চলার পক্ষে, এ প্রসঙ্গে হার্ভে ও ব্যাথার (Harvey and Bather) বলেছেন, “Conventions are not enforced, either directly or indirectly by the courts but by the weight of public opinion, which expects politicians to behave in the true spirit of the constitution.” [Harvey and Bather. The British Constitution and Politics p. 519)

ঘ. চিরাচরিত অভ্যাস : প্রথাগত বিধানসমূহ লঙ্ঘনের ফলে দেশের আইন লঙ্ঘিত হয়। ডাইসীর এই মন্তব্য আইভর জেনিংস স্বীকার করেন না। তাঁর মতে, প্রথাগত বিধানসমূহের আনুগত্য আসে আইনের ভয় হতে নয় বরং এগুলো “Code of honour” হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। আইভর জেনিংস (Ivor Jennings) রলেন, “It is easy to find conventions which are obeyed just as surely as those which Diecy mentions, although breaches of law would not follow failure to obey them.”

ড. ইংরেজ জাতির রক্ষণশীলতা ঐতিহ্যপ্রিয়তা : ইংরেজ জাতি রক্ষণশীল জাতি, তারা পুরাতন ঐতিহ্যের একনিষ্ঠ পূজারী। ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি হিসেবে তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের গৃহীত ব্যবস্থাগুলোকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে অনুসরণ করেন। ইংরেজ জাতি অতীতের সব পদ্ধতি, প্রতিষ্ঠান এবং রীতিনীতিকে সংরক্ষণের মাধ্যমে অতীতের গৌরব ফিরে পাওয়ার আনন্দ অনুভব করে।

চ. সংবিধানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে : প্রথাগত বিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আর একটি কারণ হলো- এগুলো ব্রিটিশ সংবিধানের ধারাবাহিকতা সংরক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধনে সহায়তা করে। প্রথাগত বিধানগুলো অতীতের সাথে বর্তমান এবং বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতের সেতুবন্ধনে সহায়তা করেছে। অধ্যাপক অগ এবং জিংক (Ogg and Zink) বলেছেন, “Conventions clothes the dry bones of law with flesh and make the legal constitution work and keep it abreast of changing social needs and political ideas.”

ছ. প্রথাগত বিধান গতিশীল নমনীয় : প্রথাগত বিধান মান্য করার অন্যতম কারণ হলো এগুলোর গতিশীলতা এবং নমনীয়তা। আইনের কাঠামো জটিল ও অনমনীয় প্রকৃতির কিন্তু ব্রিটেনের প্রথাগুলো যথেষ্ট গতিশীল ও নমনীয় প্রকৃতির । প্রথাগত বিধান পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে চলে।

জ. আইনে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা : কার্টার, রেনী ও হার্জ (Carter, Ranney and Herz) প্রমুখ আধুনিক লেখকগণের মতে, প্রথাগত বিধানসমূহ অমান্য করা হলে এগুলো আইনে পরিণত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ১৯০৯ সালে কমন্সসভা কর্তৃক অনুমোদিত অর্থ বিল লর্ডসভা প্রত্যাখ্যান করলে অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে লর্ডসভার ক্ষমতা হ্রাসের উদ্দেশ্যে ১৯১১ সালে পার্লামেন্টে আইন পাস হয়।

ঝ. রাজনৈতিক মনস্তাত্ত্বিক : ওয়েড ও ফিলিপস (Wade and Philips)-এর মতে, “এই প্রথাগুলো মেনে চলা হয়, কারণ রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণে জনগণ প্রথাগুলোকে প্রয়োজনীয় মনে করে।” (The question why the convertions are observed is a political and psychological question)। সুদীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা প্রথাসমূহকে অমান্য করলে জনগণ তাদেরকে ঘৃণা করবে, এবং জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। জেনিংস (Jennings)-এর মতে, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণে প্রথাগত বিধানসমূহ মান্য করা হয়।

ঞ. সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত : প্রথাগত বিধান জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ দিন ধরে জনগণ প্রথাগুলো মান্য করার ফলে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এবং দলমত নির্বিশেষে সকলেই প্রথাগুলো মেনে চলে। অধ্যাপক জেনিংস (Jennings) এর মতে, প্রথাগত বিধান জনগণের নীরব সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত।

ট, পারস্পরিক বোঝাপড়া : অধ্যাপক লাওয়েল (Lawell)-এর মতে সুষ্ঠুভাবে খেলা পরিচালনার জন্য কতকগুলো নিয়মকানুনের প্রয়োজন। খেলোয়াড়রা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এগুলোকে মেনে চলে। অনুরূপভাবে ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে প্রথাগুলোকে মেনে নিতে স্বীকৃত হয় বলেই সেগুলোর গুরুত্ব অধিক।

ঠ. কেবিনেট ব্যবস্থার অস্তিত্ব রক্ষা : প্রথাগুলো বিদ্যমান থাকার ফলেই কেবিনেটের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে। অধিকাংশ প্রথার উদ্দেশ্য হলো কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা। কমথসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যদের নিয়ে কেবিনেট গঠিত হয়। প্রথা ভেঙে ফেললে কেবিনেট ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হবে।

ড. শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা : প্রথাগত বিধানগুলো ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়ত ভূমিকা পালন করে । প্রথাগুলো লঙ্ঘন করলে শাসন কাঠামো গতিহীন হয়ে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে। এ প্রসঙ্গে কার্টার, বেনী ও হার্জ (Carter, Ranney and Herz ) বলেন, প্রথাগুলোকে অমান্য করা হলে শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং সামগ্রিকভাবে সরকারি যন্ত্র অচল হয়ে যাবে। (…….to violate them is often to make the government in self unworkable to depart from these rules in any important respect is to break down the whole machinery of government) [Carter, Ranney and Herz, The Government of Great Britain p. 40 ]

ঢ. বাস্তব উপযোগিতা : কার্টার; রেনী ও হার্জ (Carter, Ranney and Herz)-এর মতে, প্রথাগত বিধানগুলোর বাস্তব উপযোগিতার জন্যই সেগুলোকে মান্য করা হয়। অধিকাংশ প্রথার প্রধান লক্ষ্য হলো জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশ শাসিত হলে জনগণের সার্বভৌমত্ব বাস্তবায়িত হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, ব্রিটেনে প্রথাগত বিধানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের প্রধান কারণ হলো এ সকল প্রথা এখনও প্রভুত্বকারী শ্রেণির স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে ওঠেনি। ঐ সকল প্রথা যতদিন তাদের শ্রেণি-স্বার্থের অনুকূলে থাকবে, ততদিন সেগুলোর বৈধতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হবে না। কিন্তু শ্রেণি স্বার্থ বিঘ্নিত হলে প্রথাসমূহ লঙ্ঘন করতে সংশ্লিষ্ট শ্রেণি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করবে না।

প্রথাগত বিধান মান্য করার কারণ  Reasons of Obeying the Conventions

ব্রিটেনের প্রথাগত বিধানসমূহ আইন নয় এবং আদালত এগুলোকে কার্যকর করার জন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয় না। তা সত্ত্বেও ব্রিটেনে এগুলো শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে মেনে চলা হচ্ছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে প্রথাগত বিধান কেন মান্য করা হয়? এর পিছনে বিভিন্ন কারণ নিহিত। প্রথাগত বিধান মান্য করার কারণসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :

ক. শাস্তির ভয় : আগে মনে করা হতো অপসারণমূলক শাস্তির ভয়ে প্রথাগত বিধান মেনে চলা হয়। কারণ প্রথাগত বিধানসমূহ লঙ্ঘন করলে আইন প্রণয়নকারী সংস্থা শাস্তি প্রদান করতে উদ্যত হবে। কিন্তু এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলে ডাইসী প্রমুখ লেখক মনে করেন। ডাইসির মতে, শাস্তির ভয় যদি প্রথাগত বিধান মেনে চলার প্রধান কারণ হয় তাহলে এগুলোকে প্রথাগত বিধান না বলে আইন বলাই যুক্তিসঙ্গত। কারণ আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি পেতে হয়, প্রথাগত বিধান ভঙ্গ করলে নয়।

খ. আইন লঙ্ঘনের ভয় : অধ্যাপক ড্রাইসি (A. V. Diecy) বলেন, প্রথাগত বিধানগুলো লঙ্ঘন করলে চূড়ান্ত পর্যায়ে আইনের সাথে সংঘর্ষ বাধতে পারে। ডাইসির ভাষায়, The breach of these principles and conventions will almost immediately bring the offender into confict with the courts and the law of the land; যেমন—বছরে একবার পার্লামেন্টের অধিবেশন না বসলে বাজেট পাস হবে না। এই প্রথাটি লঙ্ঘন করলে আইনের সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি হবে। পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘিত হবে। সুতরাং আইনের সাথে সংঘর্ষের আশঙ্কায় ব্রিটেনে প্রথাসমূহ মেনে চলা হয়।

গ. জনমতের চাপ : প্রথাগত বিধানসমূহ মান্য করার মূল কারণ হলো ‘জনমতের চাপ’ বলে অনেকে মন্তব্য করেন। অধ্যাপক অগ (Prof. Ogg) বলেন, “প্রথাগত বিধানসমূহ মান্য করার প্রকৃত কারণ হলো জনমতের চাপ। প্রথাগত বিধানসমূহ মেনে চলা হয় কারণ জনমত চায় এগুলো মেনে চলা হোক।” (The real samction behind conventions is the force of public opinion. Conventions are obeyed because the public opinion demand’s that they must be obeyed), ব্রিটেনের জনমত সবসময় প্রথাগত বিধানসমূহ মেনে চলার পক্ষে, এ প্রসঙ্গে হার্ভে ও ব্যাথার (Harvey and Bather) বলেছেন, “Conventions are not enforced, either directly or indirectly by the courts but by the weight of public opinion, which expects politicians to behave in the true spirit of the constitution.” [Harvey and Bather. The British Constitution and Politics p. 519)

ঘ. চিরাচরিত অভ্যাস : প্রথাগত বিধানসমূহ লঙ্ঘনের ফলে দেশের আইন লঙ্ঘিত হয়। ডাইসীর এই মন্তব্য আইভর জেনিংস স্বীকার করেন না। তাঁর মতে, প্রথাগত বিধানসমূহের আনুগত্য আসে আইনের ভয় হতে নয় বরং এগুলো “Code of honour” হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। আইভর জেনিংস (Ivor Jennings) রলেন, “It is easy to find conventions which are obeyed just as surely as those which Diecy mentions, although breaches of law would not follow failure to obey them.”

ড. ইংরেজ জাতির রক্ষণশীলতা ও ঐতিহ্যপ্রিয়তা : ইংরেজ জাতি রক্ষণশীল জাতি, তারা পুরাতন ঐতিহ্যের একনিষ্ঠ পূজারী। ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি হিসেবে তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের গৃহীত ব্যবস্থাগুলোকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে অনুসরণ করেন। ইংরেজ জাতি অতীতের সব পদ্ধতি, প্রতিষ্ঠান এবং রীতিনীতিকে সংরক্ষণের মাধ্যমে অতীতের গৌরব ফিরে পাওয়ার আনন্দ অনুভব করে।

চ. সংবিধানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে : প্রথাগত বিধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আর একটি কারণ হলো- এগুলো ব্রিটিশ সংবিধানের ধারাবাহিকতা সংরক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধনে সহায়তা করে। প্রথাগত বিধানগুলো অতীতের সাথে বর্তমান এবং বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতের সেতুবন্ধনে সহায়তা করেছে। অধ্যাপক অগ এবং জিংক (Ogg and Zink) বলেছেন, “Conventions clothes the dry bones of law with flesh and make the legal constitution work and keep it abreast of changing social needs and political ideas.”

ছ. প্রথাগত বিধান গতিশীল ও নমনীয় : প্রথাগত বিধান মান্য করার অন্যতম কারণ হলো এগুলোর গতিশীলতা এবং নমনীয়তা। আইনের কাঠামো জটিল ও অনমনীয় প্রকৃতির কিন্তু ব্রিটেনের প্রথাগুলো যথেষ্ট গতিশীল ও নমনীয় প্রকৃতির । প্রথাগত বিধান পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে চলে।

জ. আইনে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা : কার্টার, রেনী ও হার্জ (Carter, Ranney and Herz) প্রমুখ আধুনিক লেখকগণের মতে, প্রথাগত বিধানসমূহ অমান্য করা হলে এগুলো আইনে পরিণত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ১৯০৯ সালে কমন্সসভা কর্তৃক অনুমোদিত অর্থ বিল লর্ডসভা প্রত্যাখ্যান করলে অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে লর্ডসভার ক্ষমতা হ্রাসের উদ্দেশ্যে ১৯১১ সালে পার্লামেন্টে আইন পাস হয়।

ঝ. রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক : ওয়েড ও ফিলিপস (Wade and Philips)-এর মতে, “এই প্রথাগুলো মেনে চলা হয়, কারণ রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণে জনগণ প্রথাগুলোকে প্রয়োজনীয় মনে করে।” (The question why the convertions are observed is a political and psychological question)। সুদীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা প্রথাসমূহকে অমান্য করলে জনগণ তাদেরকে ঘৃণা করবে, এবং জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। জেনিংস (Jennings)-এর মতে, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণে প্রথাগত বিধানসমূহ মান্য করা হয়।

ঞ. সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত : প্রথাগত বিধান জনগণের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ দিন ধরে জনগণ প্রথাগুলো মান্য করার ফলে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এবং দলমত নির্বিশেষে সকলেই প্রথাগুলো মেনে চলে। অধ্যাপক জেনিংস (Jennings) এর মতে, প্রথাগত বিধান জনগণের নীরব সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত।

ট, পারস্পরিক বোঝাপড়া : অধ্যাপক লাওয়েল (Lawell)-এর মতে সুষ্ঠুভাবে খেলা পরিচালনার জন্য কতকগুলো নিয়মকানুনের প্রয়োজন। খেলোয়াড়রা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এগুলোকে মেনে চলে। অনুরূপভাবে ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে প্রথাগুলোকে মেনে নিতে স্বীকৃত হয় বলেই সেগুলোর গুরুত্ব অধিক।

ঠ. কেবিনেট ব্যবস্থার অস্তিত্ব রক্ষা : প্রথাগুলো বিদ্যমান থাকার ফলেই কেবিনেটের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে। অধিকাংশ প্রথার উদ্দেশ্য হলো কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা। কমথসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যদের নিয়ে কেবিনেট গঠিত হয়। প্রথা ভেঙে ফেললে কেবিনেট ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হবে।

ড. শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা : প্রথাগত বিধানগুলো ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়ত ভূমিকা পালন করে । প্রথাগুলো লঙ্ঘন করলে শাসন কাঠামো গতিহীন হয়ে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে। এ প্রসঙ্গে কার্টার, বেনী ও হার্জ (Carter, Ranney and Herz ) বলেন, প্রথাগুলোকে অমান্য করা হলে শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং সামগ্রিকভাবে সরকারি যন্ত্র অচল হয়ে যাবে। (…….to violate them is often to make the government in self unworkable to depart from these rules in any important respect is to break down the whole machinery of government) [Carter, Ranney and Herz, The Government of Great Britain p. 40 ]

ঢ. বাস্তব উপযোগিতা : কার্টার; রেনী ও হার্জ (Carter, Ranney and Herz)-এর মতে, প্রথাগত বিধানগুলোর বাস্তব উপযোগিতার জন্যই সেগুলোকে মান্য করা হয়। অধিকাংশ প্রথার প্রধান লক্ষ্য হলো জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশ শাসিত হলে জনগণের সার্বভৌমত্ব বাস্তবায়িত হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, ব্রিটেনে প্রথাগত বিধানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের প্রধান কারণ হলো এ সকল প্রথা এখনও প্রভুত্বকারী শ্রেণির স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে ওঠেনি। ঐ সকল প্রথা যতদিন তাদের শ্রেণি-স্বার্থের অনুকূলে থাকবে, ততদিন সেগুলোর বৈধতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হবে না। কিন্তু শ্রেণি স্বার্থ বিঘ্নিত হলে প্রথাসমূহ লঙ্ঘন করতে সংশ্লিষ্ট শ্রেণি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করবে না।

Leave a Reply