পার্লামেন্টের সাথে কেবিনেটের সম্পর্ক

পার্লামেন্টের সাথে কেবিনেটের সম্পর্ক

পার্লামেন্টের সাথে কেবিনেটের সম্পর্ক

Relation between the Parliament and Cabinet

ব্রিটেনে পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে। পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থায় জাতীয় নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলই সরকার গঠন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃবৃন্দই কেবিনেটে স্থান লাভ করে। শাসনকার্যের জন্য কেবিনেটের সদস্যগণ ব্যক্তিগতভাবে ও যৌথভাবে পার্লামেন্টের কাছে দায়িত্বশীল থাকেন, তাই স্যার আইভর জেনিংস (Sir Ivor Jennings) বলেছেন, “কমন্সসভা এবং কেবিনেট হলো গণতন্ত্রের হাতিয়ারস্বরূপ। তাদের মাধ্যমেই রাজশক্তির বিশেষাধিকার এবং অভিজাততন্ত্রের ক্ষমতা জনমতের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়েছে।” (The House of Commons and the cabinet are the instruments of democracy. The prerogative of the crown and to a lesser degree, the powers of the aristocracy have been subordinated to public opinion. Jennings. Cabinet Government p-14 ) ব্রিটেনে পার্লামেন্টের সাথে কেবিনেটের সম্পর্ক বলতে কার্যক্ষেত্রে কমন্সসভার সাথে কেবিনেটের সম্পর্কই বোঝায়, কারণ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ কমসসভা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়। এ জন্য কেবিনেট তার নীতি ও কাজের জন্য কমন্সসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকে, লর্ডসভার কাছে নয় । কারণ লর্ডসভার সদস্যগণ মনোনীত এবং উত্তরাধিকার সূত্রে সদস্য পদ লাভ করে ।

যাহোক, কমন্সসভা এবং কেবিনেটের সম্পর্ক আলোচনার ক্ষেত্রে দুটি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা যায়।

ক. তত্ত্বগত বা তাত্ত্বিক সম্পর্ক (Theoretical Relation) এবং খ. কার্যগত বা ব্যবহারিক সম্পর্ক (Practical Relation)। ১. কমন্সসভা ও কেবিনেটের মধ্যে তাত্ত্বিক সম্পর্ক (Theoretical Relation between the House of Commons and the cabinet) : তত্ত্বগত দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কমন্সসভাই কেবিনেটকে নিয়ন্ত্রণ করে। নিম্নে পার্লামেন্ট ও কেবিনেটের সম্পর্কের তাত্ত্বিক দিক আলোচনা করা হলো :

ক. প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ : বর্তমানে রাজা বা রানী কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। পূর্বে লর্ডসভা বা কমন্সসভা পার্লামেন্টের যে কোনো কক্ষ থেকে যে কোনো নেতাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা যেত, কিন্তু ১৯০২ সালে লর্ড সলসবেরির পদত্যাগের পর লর্ডসভা থেকে আর কোনো ব্যক্তিকে স্থায়ীভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা হয়নি। কমন্সসভায় কোনো দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারলে রাজা বা রানী নিজের পছন্দমতো প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে এমন ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করতে হয়, যার পক্ষে কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন থাকে ।

খ. মন্ত্রিসভা গঠন : প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাজা বা রানী মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যকে নিয়োগ করেন, কেবিনেট মন্ত্রীদের পার্লামেন্টের যে কোনো কক্ষের সদস্য হতে হয়, প্রধানমন্ত্রী লর্ডসভা থেকেও ২-৪ জন কেবিনেট মন্ত্রী নিয়োগ করেন, পার্লামেন্টের কোনো কক্ষেরই সদস্য নন এমন ব্যক্তিকেও মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা যায়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে ৬ মাসের মধ্যে লর্ডসভা অথবা কমন্সসভার সদস্য হতে হয়, অন্যথায় তার মন্ত্রিপদ বাতিল হয়ে যায় ।

গ. মন্ত্রিসভার কার্যকাল নিয়ন্ত্রণ মঞ্জিসভার গঠনের মতো এর কার্যকালত কমসসভার উপর নির্ভরশীল। মঞ্জিসভার স্বাভাবিক কার্যকাল ৫ বছর। ঐ বছরের মেয়াদের পুরোটাই মন্ত্রিসভা ক্ষমতাসীন থাকতে পারবে কি-না তা কমপাতার আস্থার উপর নির্ভরশীল। কমপসভায় যতদিন সরকার পক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থন থাকে ততদিন মন্ত্রিসভার পক্ষে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব, কমণসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অনাস্থা প্রস্তাব আনয়ন করলে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। মুনরো এবং ওয়ার্সী বলেছেন, যখন কেবিনেট পরাজিত হয় বা পরাজয়ের সম্মুখীন হয় তখন জনগণের কাছে তার আবেদন জানানোর অধিকার আছে, প্রধানমন্ত্রী কমলসতা ভেঙে দিয়ে সাধারণ নির্বাচনের জন্য রাজা বা রাণীকে পরামর্শ দেন। পার্লামেন্টের সাথে কেবিনেটের সম্পর্ক

ঘ. কেবিনেটের দায়িত্বশীলতা। কেবিনেট তার নীতি ও কাজের জন্য পার্লামেন্ট তথা কমন্সসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকে। এ দায়িত্বশীলতা দু’ধরনের হতে পারে। যথা- (i) ব্যক্তিগত দায়িত্বশীলতা এবং (ii) যৌথ দায়িত্বশীলতা। প্রত্যেক মন্ত্রী নিজ দত্তরের সিদ্ধান্ত ও কার্যাবলির জন্য কমপসভার কাছে ব্যক্তিগতভাবে জবাবদিহি করতে বাধ্য। আবার কেবিনেট যেসব নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার জন্য সকল মন্ত্রীকে যৌথভাবে কমনসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। এ দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে না পারলে যে কোনো সময় তাদের পতন ঘটতে পারে।

ডা. মন্ত্রিসভাকে নিয়ন্ত্রণ। সরকারের নীতি বা সিদ্ধান্তসমূহের বৈদতার জন্য পার্লামেন্ট তথা কমন্সসভার অনুমোদন আবশ্যক। সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ নীতি বাস্তবায়নের জন্য কম সভায় নিপ ও প্রস্তাব উত্থাপন করতে হয়। এ সকল বিল ও প্রভাব কমন্সসভা কর্তৃক গৃহীত না হলে সরকারের পক্ষে দায়িত্বপালন করা সম্ভব নয়। বর্তমানে কমপসভায় উত্থাপিত অধিকাংশ বিলই সরকারি বিল। তাই সরকারকে বাধ্য হয়েই কমথসভার উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়।

চ. সরকারি আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণ : কমনসভা অর্থবিল এবং সরকারি আয়-ব্যয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। কমসসভার অনুমতি ছাড়া সরকার নতুন কোনো করধার্য, বাতিল বা করের হার পরিবর্তন করতে পারে না। এমনকি কমপসভার অনুমোদন ছাড়া সরকার রাজকোষ থেকে এক কপর্দক পরিমাণ অর্থও ব্যয় করতে পারে না। ব্যয় মঞ্জুরির যে দাবি সরকার কমন্সসভায় পেশ করে তা হ্রাস করার বা নামঞ্জুর করার ক্ষমতা কমন্সসভার রয়েছে।

ছ. কম সভায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা : কমথসভায় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে আলোচনা ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব, মূলতবি প্রস্তাব, ছাঁটাই প্রস্তাব, নিন্দাসূচক প্রস্তাব ও অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে কমণসভা সরকারকে কার্যকরীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাছাড়া “পার্লামেন্টারি কমিশনার” নামে কমন্সসভার একজন পদাধিকারী আছেন তাঁর মাধ্যমে কমন্সসভা কেবিনেটকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পায়। তাছাড়া বিরোধী দলের সমালোচনামূলক মনোভাব সরকারকে সতর্ক হতে বাধ্য করে।

২. কমনসভা কেবিনেটের মধ্যে কার্যগত বা ব্যবহারিক সম্পর্ক (Functional or Practical Relation between the House of Commons and the Cabinet) : কার্যগত দিক কে বিচার করলে দেখা যায়, কেবিনেটই কমন্সসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে, স্যার আইভর জেনিংস (Sir Ivor Jennings) বলেছেন, তত্ত্বগতভাবে কমন্সসভা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে, অনুযায়ী সরকার কমপসভার কাছে দায়িত্বশীল। তাত্ত্বিক অর্থে এই ধারণা অত্যন্ত বাস্তব। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, কমন্সসভা সরকারি প্রস্তাব পর্যালোচনা করে নিজের ইচ্ছেমতো তাকে পরিবর্তন করতে পারে বা কমন্সসভা সরকারকে নির্দেশ দেয়। এ কথাও সত্য সরকার কমঙ্গসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাঁর ভাষায়; “The theory is that the House controls the Government. It is equally true to say that the Government controls the House. (Jennings, The British Constitutuon p-80).” সিডনি পো (Sidney Low) বলেছেন, “The functions fulfilled by the House of Commons though it looked all important was in really otiose.” রামজে ম্যুর (Ramsay Muir) কেবিনেটের অপ্রতিহত ক্ষমতা বৃদ্ধিকে কেবিনেটের একনায়কত্ব (Dictatorship of the cabinet) বলে বর্ণনা করেছেন, তাঁর ভাষায়, “The growth of cabinet dictatorship has to a remarkable extent diminished the power and prestige of parliament robbed its proceedings of significance, made it appear that parliament exists mainly for the purpose of maintaining or somewhat ineffectually criticizing and all good omnipotent cabinet and transferred the main discussion of public issues from parliament to the platform and the members.” নিচে কমন্সসভা ও কেবিনেটের সম্পর্কের কার্যগত দিক আলোচনা করা হলো :

ক. দলীয় সংহতি শৃঙ্খলা : দলীয় সংহতি ও শৃঙ্খলার কারণে কমন্সসভার উপর কেবিনেটের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । ব্রিটেনের কার্যকরী দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় বর্তমানে রক্ষণশীল দল এবং শ্রমিক দলের মধ্যে যে কোনো একটি দল সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃবৃন্দ কেবিনেট গঠন করেন। ফলে শাসন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব দলীয় নেতাদের নির্দেশ ও সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা কমন্সসভার সাধারণ সদস্যদের থাকে না। দলীয় নেতাদের নির্দেশ উপেক্ষা করলে সংশ্লিষ্ট সদস্যের রাজনৈতিক অপমৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। হার্ভে এবং ব্যাথার (Harvey and Bather) বলেছেন, বর্তমানে দলীয় শৃঙ্খলা কমন্সসভায় সরকারের পরাজয়কে অসম্ভব করে তুলেছে।

খ. কেবিনেটের সদস্যগণ পার্লামেন্টের সদস্য : ব্রিটেনের কেবিনেটের সাথে পার্লামেন্টের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কেবিনেটের সদস্যদের পার্লামেন্টের যে কোনো কক্ষের সদস্য হতে হয়। তারা মন্ত্রী হিসেবে পার্লামেন্টের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন । কমপসভার সাধারণ সদস্যগণ একই দলভুক্ত হওয়ায় মন্ত্রীদের বিরোধিতা করতে সাহসী হন না, তাহলে সরকারের পতন ঘটবে, পার্লামেন্ট ও সরকার একই দলভুক্ত হওয়ায় কেবিনেটের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

গ. প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টের তথা কমন্সসভার নেতা : প্রধানমন্ত্রী হলেন পার্লামেন্টর নিম্নকক্ষ কমন্সসভার নেতা। কমন্সসভার অধিবেশন আহ্বান, অধিশেনের সময় কাল, আলোচনার কর্মসূচি প্রভৃতি বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁর ভূমিকার উপর দলের জয়-পরাজয় নির্ভরশীল, অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski) তাই বলেছেন, “No ordinary man has ever become the Prime Mister of England.” সরকারি দল ছাড়া তিনি বিরোধী দলের সদস্যদেরও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এমনকি বিরোধী দলের সদস্যগণ নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাকে সমীহ করেন, তাই ক্রসম্যান (Crossman) ব্রিটেনের সরকারকে প্রধানমন্ত্রীর সরকার (Prime Minister’s Government) বলেছেন ।

ঘ. আইন প্রণয়নে কেবিনেটর কর্তৃত্ব : তত্ত্বগতভাবে ব্রিটেনে আইন প্রণয়নের অধিকারী হলো পার্লামেন্ট। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে পার্লামেন্টের এই ক্ষমতা আনুষ্ঠানিক। সরকারের পিছনে কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের অকুণ্ঠ সমর্থনের নিশ্চয়তা থাকে । তাই কেবিনেট যেকোনো আইনের প্রস্তাব কমন্সসভায় সহজেই পাস করিয়ে নিতে পারে। কেবিনেটের সদস্যগণ হলেন কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃবৃন্দ। তাই সাধারণ সদস্যরা কেবিনেটের প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে পারেন না। সিডনি লো (Sidney Low) তাঁর “The Government of England” গ্রন্থে বলেন, “কমন্সসভা বর্তমানে তাঁর সাধারণ কর্তব্যের বহুমুখিনতা বিভিন্ন ধরনের কাজ এবং পর্বত-প্রমাণ স্বার্থের মধ্যে নিমজ্জিত।” (The commons is buried under the multiplicity of its nominal functions, the mountainous mass of its interests.)

ঙ. অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইন : অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইনের মাধ্যমে কেবিনেটের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। আইন প্রণয়ন পার্লামেন্টের কাজ হলেও নানা কারণে এ সংক্রান্ত কিছু দায়িত্ব পার্লামেন্ট শাসন বিভাগের হাতে অর্পণ করেছে। শাসন বিভাগ আদেশ নির্দেশ ইত্যাদি জারি করে কিংবা নিয়মকানুন, উপ-আইন ইত্যাদি প্রণয়ন করে পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত মূল আইনগুলোকে পরিপূর্ণতা দান করে। শাসন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত এই সব আদেশ নির্দেশ, নিয়মকানুন, উপ-আইন প্রভৃতিকে অর্পিত ক্ষমতা প্রসূত আইন (Delegated legislation) বলে ।

চ. আর্থিক বিষয়ে কমন্সসভার ক্ষমতা তত্ত্বগত : সরকারি আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কমন্সসভার ক্ষমতা তত্ত্বসর্বস্ব। বর্তমানে অর্থনৈতিক বিষয়ে কেবিনেট তার কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে কমন্সসভায় বাৎসরিক বাজেট পেশ করা হয়, কোনো সাধারণ সদস্য কমন্সসভায় আয়-ব্যয় সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব তুলতে পারে না। এছাড়া সরকার ব্যয় বরাদ্দের দাবি না মানলে কমন্সসভার করনীয় কিছুই নেই। আবার কেবিনেটের ব্যয় বরাদ্দের দাবি কমন্সসভা হ্রাস বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে কিন্তু বৃদ্ধি করতে পারে না। অনেক ব্যয় বরাদ্দের দাবি কমন্সসভায় বিনা বিতর্কে পাস হয় ।

ছ. কেবিনেটের কমন্সসভা ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা : ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কমন্সসভা ভেঙে দেবার ক্ষমতাও কেবিনেটের প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। কমন্সসভার সরকারি দলের মধ্যে সরকারি নীতি সম্পর্কে গুরুত্ব মতপার্থক্য দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রী কমন্সসভা ভেঙে দেবার ভীতি প্রদর্শন করতে পারে। এর ফলে নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষতের কথা চিন্তা করে কমন্সসভার সদস্যগণ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। সরকারি দল বা বিরোধী দলের কোনো সদস্যই কেবিনেটকে চটাতে চায় না। ওয়াল্টার বেজইট (Walter Bagehot) বলেছেন, “কেবিনেট একটি প্রাণী হলেও অন্যান্য প্রাণীর মতো তাঁকে মনে করা যায় না, কারণ কেবিনেট কেবল তার স্রষ্টাকে ধ্বংস করতে পারে।” (The cabinet is a creature but unlike other creatures, it has the power of destroying its own creator.)

জ. বিরোধী দলের সমালোচনা অকার্যকর বিরোধী দলের সমালোচনা, আক্রমণ, নিন্দাসূচক অথবা অনাস্থাসূচক প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমেও কেবিনেটের প্রাধান্য নিয়ণ করা সম্ভব নয়। বিরোধী দল অনাস্থাসূচক প্রস্তাব উত্থাপন করে মন্ত্রিসভাকে অপসারণ করতে পারে না। সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফলে ঐ অনাস্থাসূচক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হয়। তবে জনমত গঠনে বিরোধী দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য ।

.কমনসভার সদস্যদের গুণগতমান হ্রাস : বর্তমানে কমথসভার সদস্যদের গুণগত মান হ্রাস পেয়েছে। ফলে কেবিনেটের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আর বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ পার্লামেন্টের সদস্য পদ পেতে আগ্রহী নন। তারা সাংবাদিকতা, বেতার, টেলিভিশনের নির্বাহী পদ, কোনো কর্পোরেট ব্যবসায় গ্রুপের এম.ডি. হতে বেশি আগ্রহী। এখন আর পার্লামেন্টে জেরেমি বেছাম, জন ব্রাইট, জে. এস. মিল, লর্ড ম্যাকলে, হ্যারল্ড জে লাস্কি, এডমন্ড বার্ক, গ্লাডস্টোন প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দেখা যায় না ।

ঞ. কমনসভার সংযোগ সাধনের ক্ষমতা হ্রাস পূর্বে কমপসভা সরকার এবং জনগণের মধ্যে সংযোগ সাধনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। বর্তমানে বিভিন্ন পেশাজীবী সংস্থা ও চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর উদ্ভবের ফলে কমন্সসভার এই ভূমিকা হ্রাস পেয়েছে। এসব সংস্থা সরাসরি সরকারের সাথে নিজেদের সমস্যা ও দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করে। পূর্বে কমন্সসভা তথ্য প্রদানের উৎস হিসেবে কাজ করলেও বর্তমানে সরকারের তথ্য বিভাগ বিভিন্ন বিষয়ে জনগণকে তথ্য প্রদান করে।

পরিশেষে বলা যায়, তত্ত্বগতভাবে পার্লামেন্ট কেবিনেটকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কেবিনেটই কমন্সসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে। স্যার আইভর জেনিংস (Sir Ivor Jennings) তাই বলেছেন “ Though in one sense it is true that the House controls the Government, in another and more practical sense the Government controls the House of Commons” তবে কমন্সসভা ও কেবিনেট উভয়ের অস্তিত্ব উভয়ের উপর নির্ভরশীল। অধ্যাপক লাস্কি (Laski) যথার্থই বলেছেন, “কমন্সসভা কেবিনেটকে প্রাণদান করলেও কেবিনেটের যতদিন প্রাণ শক্তি থাকে, ততদিনই মাত্র সে নিজে বেঁচে থাকতে পারে। এটি আত্মবিশ্বাসের মূল্যে কেবিনেটের বিনাশ সাধন করে।” (A House of Commons gives the cabinet life, but normally, it can itself live only so long as it prepared to go on giving life to the cabinet. Cabinet destroys it at the cost of self-destruction).

Leave a Reply