Table of Contents
Toggleদ্বি-দলীয় ব্যবস্থার দোষ-গুণ আলোচনা কর । Discuss merits and demerits of bi party system.
দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা Bi-party System
যে রাষ্ট্রে স্পষ্টত দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দল থাকে সেই রাষ্ট্রের দলীয় ব্যবস্থাকে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা বলে। এ সকল রাষ্ট্রে একটি দল সরকার গঠন করে এবং অন্য দলটি বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। তবে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় দুটি প্রধান দল ছাড়াও আরও কিছু ছোট ছোট রাজনৈতিক দল থাকে। তবে এ দলগুলোর প্রভাব ও ক্ষমতা খুব কম। দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় মূলত দুটি দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যান্য দু’একটি দলের অস্তিত্ব থাকলেও শাসনকার্য পরিচালনায় দুটি দলই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এ দুটি দলই দীর্ঘদিন ধরে পালাক্রমে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে। যেমন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল রয়েছে। দল দুটির নাম হলো রিপাবলিকান পার্টি (Republican Party) ও ডেমোক্রেটিক পার্টি (Democratic party)। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছোট ছোট দল রয়েছে। যেমন: সোশালিস্ট লেবার পার্টি, সোশ্যালিস্ট পার্টি, সোশালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি ইত্যাদি। তবে এদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য নয়। আবার যুক্তরাজ্যে দুটো প্রধান রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব রয়েছে। যথা : রক্ষণশীল দল (Conservative party) এবং শ্রমিক দল (Labour party)। এছাড়াও যুক্তরাজ্যে কতকগুলো, ছোট ছোট দল রয়েছে। যেমন— সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, সোশ্যালিস্ট পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি ।
অ্যালমন্ড এবং পাওয়েল দ্বি-দলীয় ব্যবস্থাকে অস্পষ্ট দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা (Indistinct Bi-party System) এবং সুস্পষ্ট দ্বি- দলীয় ব্যবস্থায় (Distinct Bi-party System) বিভক্ত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্পষ্ট দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা এবং গ্রেট ব্রিটেন সুস্পষ্ট দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণতন্ত্রী দল ( Republican Party) এবং গণতন্ত্রী দলের (Democratic Party) আদর্শ ও কর্মসূচিগত তেমন কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু গ্রেট ব্রিটেনে রক্ষণশীল দল (Conservative Party) এবং শ্রমিক দল (Labour Party)-র মধ্যে আদর্শ ও কর্মসূচিগত পার্থক্য রয়েছে। অস্পষ্ট দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় মুখ্য দল দুটি গণভিত্তিক হয় না। দলীয় মতাদর্শের ওপর তেমন গুরুত্ব প্রদান করা হয় না এবং সাংগঠনিক স্তর বিন্যাস থাকে না। এ দলীয় ব্যবস্থা ব্যক্তিগত সুনামের ওপর নির্ভরশীল। অপরদিকে, সুস্পষ্ট দলীয় ব্যবস্থায় দলীয় সংগঠনের এককেন্দ্রিক প্রবণতা – থাকে। সাধারণভাবে এ দল শ্রেণিভিত্তিক। তাছাড়া কঠোর দলীয় নিয়ম-শৃঙ্খলা, দলের সাংগঠনিক স্তর বিন্যাস প্রভৃতিও সুস্পষ্ট দলীয় ব্যবস্থায় লক্ষ করা যায়। গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ায় সুস্পষ্ট দলীয় ব্যবস্থা রয়েছে।
দলীয় ব্যবস্থার আর একটি দিক হলো কার্যকরী দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা (Functional Bi-party System)। এ ব্যবস্থা বহুদলীয় ব্যবস্থার অভ্যন্তরেই গড়ে ওঠে। এতে বহু রাজনৈতিক দল থাকলেও কার্যত দুটি রাজনৈতিক দলই প্রাধান্য লাভ করে। তাদের মধ্যেই রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা সীমিত থাকে। গ্রেট ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কার্যকরী দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার গুণাবলি Merits of Bi-party System
দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার গুণাবলি নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১. সরকারের স্থায়িত্ব : দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় সরকারের স্থায়িত্ব বজায় থাকে। কারণ দুটি দলের মধ্যে যে দল সরকার গঠন করে সেই দল নির্দিষ্ট কার্যকালের মেয়াদ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে। দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ায় নির্বাচনে একটি দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ফলে দৃঢ় ও শক্তিশালী সরকার গঠন করা সহজ হয় ।
২. শক্তিশালী বিরোধী দল : দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় শক্তিশালী বিরোধী দলের অস্তিত্ব বিদ্যমান। বিরোধী দল সরকারি কার্যকলাপের গঠনমূলক সমালোচনা করে। আইনসভার ভেতরে ও বাইরে বিরোধী দলের বলিষ্ঠ ভূমিকা সরকারকে সংযত থাকতে বাধ্য করে। সরকার জনস্বার্থ বিরোধী কোনো কাজ করতে পারে না। আবার আইনসভার অধিকাংশ সদস্যের অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাসীন দল পদচ্যুত হলে বিরোধী দল সরকার গঠনের সুযোগ পেতে পারে। অধ্যাপক লাস্কি (Laski) বলেছেন, “I makes known and intelligible the result of its failure. It brings an alternative government into immediate beings.”
৩. প্রার্থী বাছাইয়ে সুবিধা : দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় দুটি দলের প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ফলে জনগণ নিজেদের পছন্দ মতো যে কোনো ব্যক্তিকে বাছাই করতে পারে। জনগণ প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিতে পড়ে না। অধ্যাপক বার্কার (Barker), “The citizen will choose most freely- when he has clear choice between two alternatives.”
৪. স্বৈরাচারিতা প্রতিরোধ : দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা সরকারের স্বৈরাচারিতা প্রতিরোধে সহায়ক। কারণ এতে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী বিরোধী দল সরকারকে দায়িত্বশীল রাখে। দুটি রাজনৈতিক দলই সম ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় সরকারি দলের পক্ষে স্বৈরাচারী আচরণ করা সম্ভব হয় না। অধ্যাপক ফাইনার (Finer) বলেন, “The two parties are better for the happiness and duty of nations than many parties.”
৫. জাতীয় স্বার্থ সংস্করণ : দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় দুটি দলই জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করে। দুটি দলই সর্বাধিক জনকল্যাণের লক্ষ্যে নীতি ও কর্মসূচি স্থির করে। কোনো দলের মধ্যেই ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা দলীয় কোনো ধরনের স্বার্থপরতার সুযোগ থাকে না ।
সুষ্ঠুভাবে শাসন পরিচালনা : এ ব্যবস্থায় কোনো সম্মিলিত সরকার (Coalition government) গঠিত হয় না। ফলে সরকার সুষ্ঠু ও নিরবচ্ছিন্নভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারে। সরকার সফলতার সাথে দেশ ও জাতির নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম হয়। অধ্যাপক লাস্কি (Laski) বলেন, “It is only method by which the people can at the electoral period directly choose the government. It enables the governments to drive its policy from the statute book.” –
৭. সন্তোষজনক ব্যবস্থা : দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা অধিকতর সন্তোষজনক। অধ্যাপক লাস্কি (Laski)-র মতে, “যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা দু’টি বড় রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক বিরোধিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, তাই অধিকতর সন্তোষজনক।” তাঁর ভাষায় “—- a political system is the more satisfactory, the more it is able to express itself through the antithesis of two great parties.”
৮. সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ : দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দলকে অন্য কোনো দলের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয় না। ক্ষমতাসীন দলের হাতে সরকারি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে। তাছাড়া এ ব্যবস্থায় সরকার স্থিতিশীল হয় এবং প্রশাসন দক্ষ হয়। ফলে সরকার তার নীতি ও সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারে।
দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার দোষাবলি Demerits of Bi-party System
দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার যেমন অনেক গুণ রয়েছে তেমনি এর দোষ-ত্রুটিও কম নয়। নিম্নে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার দোষাবলি আলোচনা করা হলো :
১. সুষ্ঠু জনমত গঠিত হয় না : দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় জনগণের সুষ্ঠু জনমত গঠিত হয় না। কারণ এতে জনগণ দুটি দলের একটিকেও পছন্দ না করলেও বাধ্য হয়ে একটি দলকে সমর্থন করে। যারা দুটি রাজনৈতিক দলের কোনোটিকে সমর্থন করেন না তাদের জন্য ‘না’ ভোটের বিধান নেই। অধ্যাপক ম্যাকাইভার (MacIver) বলেছেন, “দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা জনগণের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রকে সুনির্দিষ্টভাবেই সীমিত করে দেয়।” (The two party system puts definite limits on the political expression of public opinion).
২. মন্ত্রিসভার একনায়কত্ব : দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় কেবল একটি দলের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পার্লামেন্ট একদলীয় মন্ত্রিসভার
৩. আজ্ঞাবাহী সংগঠনে পরিণত হয়। এর ফলে মন্ত্রিসভার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার আশঙ্কা থাকে। অধ্যাপক রামজে মুইর (Ramsay Muir) এর মতে, “ব্রিটেনে দ্বি-দলীয় শাসনব্যবস্থার কারণে সেখানে মন্ত্রিসভার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে না। এ ব্যবস্থায় শুধু দুটি দলের নীতি ও কর্মসূচির প্রাধান্য থাকে। ফলে কোনো মধ্যপন্থী মতামতের প্রকাশ ঘটে না। এতে নাগরিকের রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে না।
৪. কায়েমি স্বার্থ : দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় কায়েমি স্বার্থের সৃষ্টি হয়। ক্ষমতাসীন সরকারি দল একটি শ্রেণির স্বার্থকেই কায়েম করে। অথচ সমগ্র দেশে বহু শ্রেণির বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ থাকে। ফলে দেশ ও দেশবাসীর বৃহত্তর স্বার্থ উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
৫. দলীয় অসহিষ্ণুতার সৃষ্টি: দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনপুষ্ট ক্ষমতাসীন দল নিজের সকল সিদ্ধান্তকে অভ্রান্ত বলে মনে করে এবং তা নির্বিচারে প্রয়োগ করে। অন্য মতাবলম্বীদের মতামতকে তারা অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে। ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী দলের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব সৃষ্টি হয় ।
৬. বহুমুখি সমস্যা সমাধানের অনুপযোগী : দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় বহুমুখি সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও সেগুলো সমাধান করা কষ্টকর। কেননা এতে কোনো সমস্যাকে বহুমুখি দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা যায় না।