জনমত পরিমাপের পদ্ধতি

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনমতকে শাসনব্যবস্থার ‘স্নায়ুকেন্দ্র’ বা প্রাণ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান পরিচালিত হয় জনমতের উপর ভিত্তি করে। জনমত পরিমাপের জন্য কতিপয় কিছু পদ্ধতি রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জনমত পরিমাপের জন্য যে সকল পদ্ধতিসমূহ আলোচিত হয়ে থাকে সেগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো :

১. গণভোট : গণভোট বা রেফারেন্ডাম হলো জনমত যাচাইয়ের একটি অন্যতম পরিমাপক। এর মাধ্যমে সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কিংবা নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে অথবা গুরুত্বপূর্ণ কাউকে সরকারি ক্ষমতা থেকে অপসারণের জন্য গণভোট পদ্ধতি কার্যকর করা হয়। এর মাধ্যমে জনমত গঠিত হলে সে অনুযায়ী আইনি কার্যধারা বলবৎ হয়।

২. সাধারণ নির্বাচন : আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনমত পরিমাপের প্রকৃষ্টতম পদ্ধতি হলো সাধারণ নির্বাচন। সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে কোন সরকারের প্রতি বা রাজনৈতিক দলের প্রতি সহজেই জনমতের পরিমাপ করা যায় এবং সে অনুযায়ী আধুনিক রাষ্ট্রসমূহের সরকার গঠিত হয় ।

৩. জরিপ : অনেক সময় দেশব্যাপী কিংবা কোনো কোনো অঞ্চলে জরিপের মাধ্যমে জনমত যাচাই কিংবা পরিমাপ করা হয় । বিশেষ করে কিছু কিছু রাজনৈতিক বিষয়ে গবেষণা বা বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে জরিপ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে জনমতের সুষ্ঠু প্রতিফলন ঘটে বলে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন ।

৪. হ্যাঁ-না ভোট : জনমত পরিমাপের অপর আরেক পদ্ধতি হলো হ্যাঁ-না ভোট। তবে জনমত পরিমাপের এ পদ্ধতিকে কেন্দ্ৰ করে বিতর্ক রয়েছে। অনেকের মতে, এটি একটি শ্রেষ্ঠ ও কার্যকরী পদ্ধতি। আবার অনেকের মতে, এটি একটি ভ্রান্ত পদ্ধতি । তবে সাধারণত সামরিক শাসকগণ ক্ষমতা দখলের পর তাতে বৈধতা আনয়নের জন্য এ পদ্ধতিটি ব্যবহার করে থাকেন। ৫. সংবাদপত্র : সংবাদপত্রে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত আহ্বান করা হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় সংবাদপত্র জনমত তৈরিতে ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে এ পদ্ধতিতে আংশিক তথা জনমতের সচেতন অংশের পরিমাপ হয় বলেই অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন।

৬. চলচ্চিত্র, প্রকাশনা অন্যান্য : চলচ্চিত্র নির্মাণের ধরন যাচাই বা পরিমাপ করা যায়। তবে এ পদ্ধতিটি মূলত জনমত বিনির্মাণ বা গড়ে তোলার জন্য ব্যবহার করা হয়।

৭. স্বাক্ষর সংগ্রহ করা : স্বাক্ষর সংগ্রহের মাধ্যমে জনমত পরিমাপ করা সম্ভব হয়। এটি মূলত অতিশয় সহজ জনমত গঠনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। তবে এ পদ্ধতিতেও জনমত যাচাই বা পরিমাপের কিছুটা জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়।

৮. গণমাধ্যমের জরিপ : কোনো বিশেষ বিষয়ে গণমাধ্যমে পরিচালিত জরিপের ফলাফলও জনমত যাচাই বা পরিমাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। কারণ অনেক সময় গণমাধ্যমে কোনো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত আহ্বান করা হয়। তবে অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর মতে, গণমাধ্যম বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত গঠনের প্রধান মাধ্যম।

৯. সাক্ষাৎকার মতামত গ্রহণ। বিভিন্ন গণমাধ্যম যারা কিংবা সরাসরি সাক্ষাৎকার ও মতামত গ্রহণের মাধ্যমে পরিমাপ করা যায়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত কোনো বিষয়ে জনমত যাচাই বা পরিমাপ করতে সাধারণত এ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়।

১০. গোলটেবিল বৈঠক আলোচনা জনমত পরিমাপের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি হলো গোলটেবিল বৈঠক। সুশীল সমাজের বিশিষ্ট অংশের গোলটেবিল বৈঠক ও আলোচনার মাধ্যমে দেশের কোনো রাজনৈতিক দল, কিংবা পরিস্থিতি, কিংবা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে জনমত যেমন গঠন করা যায় তেমনি জনমত পরিমাপও করা যায়।

উপরিউক্ত পদ্ধতিসমূহ ছাড়াও জনমত পরিমাপের আরো কিছু পদ্ধতি রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সুচিন্তিত মতামত, উপ-নির্বাচন, কোনো কিছু গ্রহণ বা বিতরণের জন্য জনগণের সাড়া, জনগণের মনোভাব, আন্দোলন, সভা- সমিতি প্রভৃতির ধরন ও বক্তব্য ইত্যাদি। পরিশেষে বলা যায় যে, জনমত গঠনের যেমন কতগুলো বাহন রয়েছে, তেমনি জনমত পরিমাপ বা যাচাইয়েরও অনেকগুলো পদ্ধতি রয়েছে।

 

প্রেস যেভাবে চায় জনমত সেভাবে তৈরি হয় Public Opinion builds as per the Press desires

জনমত সকল ক্ষমতার আধার। সরকারের উত্থান-পতন জনমতের মতামতের উপর নির্ভরশীল। এমনকি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব পর্যন্ত নির্ভর করে জনমতের উপর। জনমত না থাকলে রাষ্ট্র বিলুপ্ত হবে। প্রেস বলতে জনমতের বাহন যেমন- পরিবার, এলিট, শ্রেণি, সভা-সমিতি ইত্যাদিকে বুঝানো হয়। এসবের মাধ্যমে জনগণ যে মত প্রকাশ করে জনমত সেভাবেই গড়ে ওঠে। অর্থাৎ প্রেস জনমত অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। জনগণ যদি কোন সরকারের পক্ষে বিরূপ হয় তবে সেই সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব হয় না। জনগণ সরকারের কোনো কর্মসূচিকে সমর্থন করলে তা যেমন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রহণযোগ্যতা পায়, তেমনি আবার সরকারের কোনো কর্মসূচির প্রতি জনগণ একমত পোষণ না করলে তা বাতিল হয়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে সরকারের টিকাদান কর্মসূচির কথা বলা যায়। পিতামাতা যদি সন্তানকে টিকাদানের জন্য টিকাদান কেন্দ্রে নিয়ে না যায় তবে সরকারের এ কর্মসূচি সফল হবে না। সুতরাং বলা যায় কোনো একটি দেশের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে সরকার গঠন, পরিচালনা তথা সার্বিক ক্ষেত্রে জনমতের প্রতিফলন দেখা যায়। তাই বলা যায়, “প্রেস যেভাবে চায় জনমত সেভাবে গড়ে ওঠে।”

একটি যুক্তিসিদ্ধ ও কল্যাণধর্মী জনমতের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ অশিক্ষিত হওয়ায় তাদের পক্ষে সঠিক মতামত প্রদান করা সম্ভব হয় না। অনেকক্ষেত্রে অশিক্ষিত জনগণের প্রদত্ত মতামত দেশে কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ বয়ে আনে। একটি ত্রুটিপূর্ণ জনমত যেমন দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে তেমনি একটি যুক্তিপূর্ণ মতামত দেশকে উন্নয়নের দিকে ধাবিত করতে পারে। সুশীল সমাজ যদি তাদের মতামতকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে না পারে তাহলে প্রেস তা সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারে ! তারা যদি সরকারি কাজের প্রশংসা এবং বিরোধী দলের কাজের বিরোধিতা করে তবে তাদের মত সুষ্ঠু হবে না। এ ধরনের অভিমত দিয়ে সুন্দর ও নিরপেক্ষ জনমত গঠন করা যায় না। দিনে দিনে আমরা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। তাই আমরা বলতে পারি একটি সুষ্ঠু-সুন্দর জনমত গঠনের জন্য জাতীয়তাবোধকে আগে সংরক্ষণ করতে হবে। আবার একই সাথে জনগণকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে এবং জনগণের সুন্দর মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে।

Leave a Reply