জনমতের গুরুত্ব

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হলো সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। কেননা, সরকারের সফলতা জনমতের উৎকর্ষের উপর নির্ভরশীল। জনমতের গুরুত্বকে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে আলোচনা করা যেতে পারে ঃ

১. সরকার গঠন : জনমত সরকার গঠনের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। কেননা, নির্বাচন হলো জনমত গঠনের একটি অন্যতম মাধ্যম। নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক দলসমূহ তাদের প্রার্থী মনোনীত করে। জনগণ চিন্তা-ভাবনা করে নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। আর এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় জনমতের গুরুত্ব অপরিসীম।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুসংহতকরণ : জনমত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত ও শক্তিশালী করে। কেননা, জনমত সরকারের বিরুদ্ধে গেলে সরকারের পতন ঘটবে বিধায় গণতান্ত্রিক সরকার জনমতকে প্রাধান্য দেয়। নির্বাচিত প্রতিনিধি জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করতে পারে না। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, “People are the source of power.”

আইন প্রণয়ন : আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনমতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে জনগণের মতামত সংগ্রহ করে থাকে। আর এই প্রক্রিয়ায় সরকার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। ফলে সরকার আইন প্রণয়নের পাশাপাশি শাসনব্যবস্থায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।

  1. স্বৈরশাসন রোধ : জনমত কার্যকর না থাকলে সরকার অন্যায় ও অবৈধ কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। ফলে সরকার নিজেদের ইচ্ছেমতো স্বৈরাচারী পন্থায় দেশ পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, জনমত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের স্বৈরচারিতা রোধ করে। কেননা, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা হারানোর ভয়ে জনমতের প্রতি দৃষ্টি রেখে নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।

৫. জনকল্যাণ : জনমত জনকল্যাণ সাধনে সহায়তা করে থাকে। কেননা, বর্তমান রাষ্ট্র আর পুলিশী রাষ্ট্র নয় বিধায় সরকার জনমত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সুষ্ঠু ও কল্যাণকর নীতি প্রণয়ন করে থাকে। যে কারণে জনমত গঠনে অবাধ স্বাধীনতা থাকা উচিত। অবাধ স্বাধীনতা থাকলে জনগণ কল্যাণমুখী কাজ করতে সরকারকে উদ্বুদ্ধ করে থাকে ।

৬. সরকারের গতিশীলতা বৃদ্ধি : জনমত রক্ষণশীলতা দূর করে আধুনিক মতামতকে প্রাধান্য প্রদান করে বিধায় সরকারের গতিশীলতা দানে জনমতের প্রভাব ব্যাপক। জনমত আধুনিক বিষয়সমূহ সরকারের নিকট তুলে ধরে। ফলে সরকার যুগের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। আর এভাবে রক্ষণশীলতা পরিহার করে সরকারকে গতিশীল করে তোলে।

৭. ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণ : ব্যক্তিস্বাধীনতা গণতন্ত্র বিকাশের জন্য অপরিহার্য। আর ব্যক্তি যদি তার স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে পারে তবেই ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। জনমতের ভয়ে সরকার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। আর এভাবে জনমত ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি উপায় হিসেবে কাজ করে।

৮. দমন নীতি রোধ : সরকার অনেক সময় দমন নীতি অনুসরণ করে থাকে। কিন্তু গণতন্ত্রে জনগণের মনোভাব ও মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকে বিধায় তারা সরকারের পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করতে পারে। এমনকি সচেতন জনগণ সরকারের সমালোচনা ও বিরোধিতা করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না। ফলে সরকার জনমত হারানোর ভয়ে দমননীতি পরিহার করে।

৯. বিরোধী মতামত প্রকাশ : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমত বিরোধী মতামত প্রকাশে সহায়তা করে। কেননা, জনমতে পরস্পর বিরোধী মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকে। সরকারের কোনো বিশেষ ইস্যুতে গৃহীত সিদ্ধান্তের অনুকূলে জনমতের সবটুকু যায় না, বরং বিপক্ষেও যেতে পারে। জনমতের ন্যায় অন্য কোনো উপায়ে পরস্পর বিরোধী মতামত ততটা প্ৰকাশ পায় না ।

১০. অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা মানেই অংশগ্রহণের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। সকলেই এখানে মতামত প্রকাশ করতে পারে, অংশগ্রহণ করতে পারে এবং নিজস্ব মতামত গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করতে পারে। সমালোচনার প্রবণতা ও মাত্রা বিচারে শাসকব্যবস্থা গ্রহণ ও আইন প্রণয়ন করতে উদ্যোগী হয়। আর এতে করে জনমতের প্রতিফলন ঘটে।

১১. সরকারের সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রতিটি সরকার অর্জনে সচেষ্ট থাকে। আর এক্ষেত্রে জনগণের অভিমত সরকারের সাফল্য অর্জনে সহায়তা করে থাকে। যে কারণে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমত প্রাধান্য পায়।

১২. সরকারের স্থায়িত্ব : সরকারের স্থায়িত্বের ক্ষেত্রেও জনমতের গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়। যে কারণে জনমতের সমর্থন ব্যতীত সরকার দৃঢ় ও শক্তিশালী হতে পারে না। কারণ সরকার মনে করে যে, জনমত সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেলে সরকারের পতন ঘটবে। যে কারণে সরকার জনগণের অভিমতকে প্রাধান্য প্রদান করে থাকে। ফলে সরকারের কার্যকর সফলতা আসে।

১৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য শর্ত। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। আর এক্ষেত্রে জনমতসহ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কারণ সরকার জানে জনমতের বিরোধিতা করলে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিপ্লব হতে পারে। এমতাবস্থায় সরকার জনমতকে প্রাধান্য দিলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা বিরাজ করে।

১৪. ব্যক্তিস্বার্থ সামাজিক স্বার্থের সমন্বয় : ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থ বহুক্ষেত্রেই স্বতন্ত্র হয়। অনেকক্ষেত্রে এই দু’য়ের স্বার্থের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় । গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমত ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের সমন্বয় সাধন করে।


বিভিন্ন সরকার ব্যবস্থায় জনমতের ভূমিকা Role of Public Opinion in Different Types of Political System

বিভিন্ন সরকার ব্যবস্থায় জনমতের ভূমিকা বিভিন্ন রকম। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :

১. উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত (Public Opinion in Liberal Democracy) : এ ব্যবস্থায় জনগণের বাক-স্বাধীনতা পূর্ণমাত্রায় স্বীকৃত হয়। সভা-সমিতি, রাজনৈতিক দল গঠন, ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদির আইনসঙ্গত অধিকার সকল নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত থাকে। ফলে জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পায়। গণতন্ত্রকে জনগণ কর্তৃক পরিচালিত শাসনব্যবস্থা বলা হয়। এ ব্যবস্থায় জনগণ সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। সরকার জনস্বার্থ- বিরোধী কোনো নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে। যে কারণে জনমতের উপর গণতান্ত্রিক সরকারের সাফল্য নির্ভরশীল। এজন্য সরকার জনমতকে উপেক্ষা করতে পারে না। জনমত সরকারকে গতিশীলতা দান করে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে ।

২ . সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত (Public Opinion in Socialism) : সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একাধিক রাজনৈতিক দল না থাকায় দেশের প্রচার মাধ্যমগুলোও থাকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত। একটি মাত্র জাতীয় দল কমিউনিস্ট পার্টি এবং কমিউনিস্ট সরকারের অপ্রতিহত নিয়ন্ত্রণে জনমতের আত্মপ্রকাশ সম্ভব হয় না। সমাজতন্ত্রে সর্বহারা শ্রেণির একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সমাজ থেকে কমিউনিস্ট মতাদর্শের বিরোধী সকল মত ও দলকে কঠোরভাবে উৎখাত করা হয়। আর এতে করে এ ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বহারা শ্রেণি রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় ।

৩. স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত (Public Opinion in Tyranny) : স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় কঠোর হস্তে সরকার বিরোধী সকল প্রকার মত ও দলকে দখল করে একাধিপত্য কায়েম করা হয়। এ ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু ক্ষমতাসীনদের মতকে জনমত হিসেবে প্রচার করা হয়। শাসকবর্গ রাজনৈতিক সংহতি ও আনুগত্য লাভের জন্য বলপ্রয়োগের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে বিধায় সরকার বিরোধী জনমত সহজে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না।

৪. ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় জনমত (Public Opinion in Facisim) : ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় সমাজের সর্বস্তরে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ পরিব্যাপ্ত। ব্যক্তির সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমনকি পারিবারিক জীবনের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান। শুধুমাত্র সরকারি কর্তৃপক্ষের মতামতকে এককভাবে দেশের সকল প্রচার মাধ্যমে প্রচার করা হয়। সরকার বিরোধী সব কিছুকে কঠোর হস্তে দমন করা হয়। যে কারণে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় জনমতের ভূমিকা নিষ্ক্রিয় বলা যায়। জার্মানি ও ইতালিতে এরূপ ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল।.

পরিশেষে বলা যায়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনমতের গুরুত্ব ও ভূমিকা অপরিসীম। কেননা, গণতান্ত্রিক সরকার জনমতের উপর নির্ভরশীল বিধায় জনমতকে উপেক্ষা করতে পারে না। জনমত বিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ মানেই সরকারের পতন। যে কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত গঠনের বাহন বা মাধ্যমগুলোর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Reply