চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সংজ্ঞা

আধুনিককালের সমাজব্যবস্থা বিভিন্ন চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। এ সকল গোষ্ঠীর সরাসরি ক্ষমতা দখলের কোনো আগ্রহ থাকে না। সরকার গঠন করাও এদের উদ্দেশ্য নয়। সমস্বার্থের ভিত্তিতে গঠিত এ সকল গোষ্ঠী সরকারি নীতির পরিবর্তন এবং সরকারি সিদ্ধান্তকে নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থের অনুকূলে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে থাকে। তথাপি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে Allan R. Ball Modern Politics and Government’, “Pressure groups are firmly part of the political process and they attempt to reinforce or change the direction of government poling, but do not wish, as pressure groups, to become the government.”

 গোষ্ঠীর সংজ্ঞা Definition of Groups

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সংজ্ঞা আলোচনার পূর্বে আমাদেরকে জানতে হবে গোষ্ঠী বলতে কী বুঝায়। গোষ্ঠী বলতে সেই জনসমষ্টিকে বুঝায় যেখানে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি বিশেষ সুবিধা লাভের জন্য একত্রিত হয়।

১. ডেভিড ট্রুম্যান ( David Truman)-এর মতে, “গোষ্ঠী হলো বহু ব্যক্তির সমষ্টি। এ ব্যক্তি-সমষ্টি এক বা একাধিক মনোভাবের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। তাঁরা ঐ মনোভাবের মধ্যে নিহিত আচার-আচরণ প্রতিষ্ঠা, সংরক্ষণ ও প্রসারের জন্য সমাজের অন্য গোষ্ঠীর উপর কতগুলো দাবি পেশ করে। এ অংশীদারি মনোভাবই স্বার্থের জন্ম দেয়।”

২. আর্থার বেন্টলী (Arther Bently) স্বার্থকেই গোষ্ঠীর ভিত্তিরূপে গণ্য করেছেন। গোষ্ঠীভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একই ধরনের মনোভাব না থাকলে স্বার্থ গড়ে উঠতে পারে না। সমাজে এক গোষ্ঠীর উপর অন্য গোষ্ঠী কর্তৃক উপস্থাপিত দাবির সাথে যুক্ত অংশীদারি মনোভাবকেই (Shared Attitude) বেন্টলী স্বার্থ (Interest) নামে অভিহিত করেছেন।

৩. হ্যাগেন বেন্টনী ( Hagen and Bentony) গোষ্ঠী বলতে বুঝেন, “Any mass of human activity terming in a common direction.”

৪. ব্রুম (Broom)-এর মতে, “The group is a collection of persons who are bound together by disticntive

of social relation.”

সুতরাং সাধারণভাবে বলা যায়, গোষ্ঠী হচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ জনসমষ্টি যা সমজাতীয় স্বার্থে একত্রিত 1

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী  Pressure Group

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সংজ্ঞা এবং নামকরণ নিয়ে বেশ সমস্যা রয়েছে। অধ্যাপক ফাইনার এ জাতীয় গ্রুপকে ‘লবি’ (l.obby) বলার পক্ষপাতি। অনেকে আবার চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বলতে ‘স্বার্থগোষ্ঠ’ (Interest Groups); ‘রাজনৈতিক গোষ্ঠী’ (Political Groups); ‘সংগঠিত গোষ্ঠী’ (Organized Groups ) ; ‘মনোবৃত্তিবাহী গোষ্ঠী’ (Attitude Groups) প্রভৃতি পরিভাষা ব্যবহার করেছেন।

  • নামকরণের সমস্যা সম্পর্কে এলান বল (Allan Ball) একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি ‘চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী’ এ শব্দগুচ্ছকে একটি ব্যাপৃত বর্গনাম হিসেবে ব্যবহারের পক্ষপাতি এবং এক্ষেত্রে তিনি চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে ‘স্বার্থগোষ্ঠী’ এবং ‘মনোবৃত্তিবাহী গোষ্ঠী’ এ দু’ভাগে ভাগ করার কথা বলেছেন। তাঁর ভাষায়, “One solution to these problems is to use the term ‘Pressure Group’ at a broad generic title…… and divide pressure groups into two broad categories, interest groups and attitude groups.”

এবার চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর সংজ্ঞায় অধ্যাপক বল (Prof. Ball) বলেন, “A pressure group can be defined as a group whose members hold shared attitude.”

১. এইচ. জিগলার (H. Zeigler)-এর ভাষায়, “চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হলো এমন একটি সংগঠিত জনসমষ্টি, যা তার সদস্যদের সরকারি পদে বসাবার চেষ্টা না করে সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।”

২. অধ্যাপক অ্যালমন্ড ও পাওয়েল (G. A. Almond & G. B. Powell )-এর ভাষায়, “সমাজে বিভিন্ন ধরনের গোষ্ঠীগুলো যখন তাদের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ ব্যক্ত করে এসব চাহিদা বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা চালায় তখন এ সমস্ত গোষ্ঠীকে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বলা হয়। “

৩. ডেভিড ট্রুম্যান (David Truman)-এর মতে, “চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হলো এমন এক গোষ্ঠী যার সদস্যরা অংশীদারি মনোবৃত্তি বা একই ধরনের মনোভাবের ধারক ও বাহক। “

৪. . জন সি. পিয়ার্স (Pears)-এর মতে, “চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হলো এমন একটি ব্যক্তিসমষ্টি, যার লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর দাবি পেশের মাধ্যমে সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করা।”

৫. আর. এম. ম্যাকাইভার (R. M. Maclver) স্বার্থকামি তথা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, “A number of man united for the defense, maintenance or enhancement of any, more or less enduring position or advantages which they posses alike or in common.”

৬. অধ্যাপক নিউম্যান ( Prof. Neuman)-এর মতে, “Fundamentally pressure groups are the representation

of homogeneous interests seeking influence.”

৭. গ্রাহাম উইলসন (Graham Wilson)-এর মতে, “It (Pressure Group) is an organization which seeks or claims to represent people or organizations which share one or more common interests or ideas.” ৮. অধ্যাপক মাইরন ওয়েনারের (Pro. Myron Weiner)-এর মতে, “By interest group we mean any voluntary organized group, outside the governmental structure, which attempt to influence the nomination and appointment of governmental personnel, the adoption of public policy, its administration or its adjudication.”

সুতরাং বলা যায়, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বলতে এমন এক গোষ্ঠীকে বুঝায়, যার সদস্যগণ সমজাতীয় মনোভাব এবং স্বার্থের দ্বারা আবদ্ধ, স্বার্থের ভিত্তিতেই তাঁরা পরস্পরের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করে নীতি প্রণয়নকে নিজেদের অনুকূলে আনয়নের জন্য কার্য পরিচালনা করে।

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য Characteristics of Pressure Group

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর উপরিউক্ত সংজ্ঞাসমূহ বিশ্লেষণ করলে এর নিম্নোক্ত কতিপয় বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় :

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এরা কোনোরূপ দলীয় কর্মসূচি প্রণয়ন বা ঘোষণা করে না। এমনকি নির্বাচনে প্রার্থীও মনোনয়ন করে না।

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ প্রকাশ্যে না হলেও অন্তত প্রচ্ছন্নভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে থাকে।

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ কোনো সরকারি পদ লাভের জন্য নয় বরং তাদের স্বার্থ আদায়ের জন্য সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করে।

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের সমষ্টি বিশেষ এবং এরা অন্যান্য গোষ্ঠীর ন্যায় কতিপয় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন, স্বার্থ আদায় বা রক্ষার উদ্দেশ্যে সংগঠিত হয়।

৫. চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ মূলত নির্দলীয় সংগঠন এবং তারা কেবল সংগঠিত সামাজিক গোষ্ঠী বিশেষ।

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করতে চায় না। বরং সরকারি নীতি ও সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণকে প্রভাবিত করার জন্য সচেষ্ট থাকে।

চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর শ্রেণিবিভাগ Classification of Pressure Group / Interest Group

স্বার্থগোষ্ঠী বা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর শ্রেণিবিভাগ করা খুব সহজসাধ্য বিষয় নয়। কারণ প্রতিটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় অসংখ্য চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে। অ্যালমন্ড ও পাওয়েল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় চার প্রকার চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর কথা বলেছেন। এগুলো হলো :

১. প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী (Institutional Interest Group) : রাজনৈতিক দল, আমলাতন্ত্র, আইনসভা ইত্যাদি আনুষ্ঠানিক সংগঠনকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থানেষী গোষ্ঠী বা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বলা হয়। এসব আনুষ্ঠানিক সংগঠনের সদস্যপদ বৃত্তি বা পেশামূলক। সুনির্দিষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্ম সম্পাদনের উদ্দেশ্যে এগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। এরূপ প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নিজ স্বার্থের গ্রহণ ছাড়াও সমাজের অন্যান্য গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে ।

২. অসংঘমূলক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী (Non-associational Interest Group) : জাতি ও রক্ত সম্পর্কগত গোষ্ঠী, কূলগত, আঞ্চলিক, ধর্মীয় এবং মর্যাদা অনুসারী গোষ্ঠী হচ্ছে অসংঘমূলক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। এদের কোনোরূপ আনুষ্ঠানিক সংগঠন নেই এবং স্বার্থ গ্রহণের জন্য সংগঠনগত কোনো ব্যবস্থা বা পদ্ধতি নেই। অনানুষ্ঠানিকভাবে এরা এদের স্বার্থ গ্রহণ করে থাকে । ৩. দাঙ্গা-হাঙ্গামাকারী গোষ্ঠী/ তাৎক্ষণিক গোষ্ঠী (Anomic Interest Group) : রাজনৈতিক ব্যবস্থাতে অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ ধরনের গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে থাকে। কিন্তু এজন্য বিশেষ বিশেষ ঘটনার প্রয়োজন হয়। কারণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আকস্মিকভাবে এরূপ গোষ্ঠীর উৎপত্তি। দাঙ্গায় অংশগ্রহণ এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন এর মুখ্য উদ্দেশ্য। যেমন— কোনো দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ কোনো জনসমষ্টির কথা বলা যায়।

৪. সংঘমূলক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী (Associational Interest Group) : শ্রমিক সংঘ, ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিদের সংগঠন, কুলগত সংঘ ইত্যাদি হচ্ছে সংঘমূলক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। এরূপ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থে প্রকাশ্যে প্রতিনিধিত্ব করা, সাধারণত স্বার্থ ও দাবির পক্ষে সুবিন্যস্তভাবে নিয়মনীতি বা পদ্ধতি প্রণয়ন করে এবং এ সকল দাবি-দাওয়া অপরাপর রাজনৈতিক কাঠামো যেমন রাজনৈতিক দল, আইনসভা ও আমলাতন্ত্রের নিকট উপস্থাপন করে। ডেভিড ট্রুম্যান (David Truman) স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথা :

১. রাজনৈতিক স্বার্থকামি গোষ্ঠী (Political Interest Group) : এ ধরনের গোষ্ঠী স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সরকারের নিকট প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করে।

২. অরাজনৈতিক স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ( Non-political Interest Group) : এ ধরনের গোষ্ঠীসমূহ যদিও সরকারের কার্যাবলির সঙ্গে যুক্ত থাকে তথাপি সময়ের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক কার্যাবলির সাথেও সংশ্লিষ্ট থাকে।

Leave a Reply