গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগের ভূমিকা বা ক্ষমতা
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগের ভূমিকা বা ক্ষমতা
Role or Power of the Executive in Democratic System
সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে শাসন বিভাগ নিম্নোক্ত কার্যক্রম সম্পাদন করে
১. শাসন সংক্রান্ত কার্য : শাসন বিভাগ শাসন সংক্রান্ত দৈনন্দিন কার্যাবলি সম্পাদন করে। কেননা, দেশের শাসনকার্যের নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখা শাসন বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শাসন বিভাগকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের পুরো প্রশাসন যন্ত্রটি পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রের প্রয়োজনানুসারে কর্মচারীদের নিয়োগ, তাদের বেতন ও কাজের শর্ত স্থির করা এবং কর্মচারীদের বরখাস্তকরণ কার্য শাসন বিভাগই পরিচালনা করে থাকে।
আইন সংক্রান্ত কার্য : বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসন বিভাগকে কতকগুলো আইন সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। যে কারণে অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান আইনসভার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য হন। তিনিই আইনসভার অধিবেশন আহ্বান করেন এবং প্রয়োজনবোধে তিনিই আইনসভার অধিবেশন স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। তিনি ইচ্ছা করলে আইনসভা ভেঙেও দিতে পারেন। তাঁর সম্মতি ব্যতীত কোনো বিল আইনে পরিণত হয় না। অর্থাৎ, আইনসভায় বাণী প্রেরণ, আইনসভার অধিবেশন আহ্বান, বিলে সম্মতি বা ভেটো প্রদান, বিশেষ অধ্যাদেশ জারি, আইনসভাকে অনুপ্রাণিতকরণ, বিল প্রস্তুতকরণ প্রভৃতি আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কার্য শাসন বিভাগ বিশেষ ক্ষমতাবলে করে থাকে। শাসন বিভাগ উপ-আইন (by-law) প্রণয়ন করে আইনের ফাঁক পূরণ করে। এই প্রক্রিয়ায় আইন প্রণয়নকে “হস্তান্তরিত আইন” ( Delegated Law) বলে।
৩. আইন বাস্তবায়ন : আইন বাস্তবায়ন করা শাসন বিভাগের মুখ্য কাজ। সকল ধরনের সরকার ব্যবস্থায় শাসন বিভাগ আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে থাকে। যেমন : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সরকারের তিনটি বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলি পৃথক করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে শাসন বিভাগের কাজ হলো আইনসমূহ বিশ্বস্ত তার সাথে কার্যকর করা।
- বিচার সংক্রান্ত কার্য : শাসন বিভাগের কিছু পরিমাণ বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতাও রয়েছে। অনেক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের নিয়োগ করে থাকেন। তিনি দণ্ডিত অপরাধীর দণ্ড হ্রাস, স্থগিত ও মওকুফ করতে পারেন। আবার কর নির্ধারণ, নিয়োগ, পদোন্নতি, পদচ্যুতি প্রভৃতি বিষয়ে আপত্তি নিষ্পত্তি শাসন বিভাগই করে থাকে। অনেক রাষ্ট্রে সরকারি কর্মচারীদের বিচার সংক্রান্ত কার্য পরিচালনার জন্য “প্রশাসনিক আদালত” রয়েছে। শাসন বিভাগই এ ধরনের আদালত পরিচালনা করে থাকে। তবে শাসন বিভাগের এ ধরনের বিচার সংক্রান্ত কাজকে ‘আধা-বিচার-বিভাগীয়’ কাজ বলা হয়। কারণ এ কাজ প্রকৃতপক্ষে বিচার বিভাগের কার্য সম্পাদনের মতো নয়।
৫. অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা : শাসন বিভাগের প্রধান কাজ হলো রাষ্ট্রের মধ্যে আইন প্রয়োগ করা, নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, স্থায়ী কর্মচারীদের নিযুক্ত করা প্রভৃতি। ব্যাপক অর্থে শাসন বিভাগকে অভ্যন্তরীণ শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয় । এই কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে শাসন বিভাগের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের উপর। স্বরাষ্ট্র দপ্তর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ বাহিনী গঠন ও পরিচালনা করে থাকে।
৬. পররাষ্ট্র সংক্রান্ত কার্য : পররাষ্ট্র সংক্রান্ত যাবতীয় কার্য শাসন বিভাগের গুরু দায়িত্ব হিসেবে গণ্য হয়। পররাষ্ট্র বিষয়ক কার্য বলতে অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন, বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ, অন্য দেশে রাষ্ট্রদূত প্রেরণ এবং অন্য দেশের রাষ্ট্রদূতকে নিজ রাষ্ট্রে গ্রহণ ইত্যাদি বোঝায়। রাষ্ট্রের প্রতিভূ হিসেবে রাষ্ট্রপ্রধানই এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। শাসন বিভাগের পররাষ্ট্র দপ্তর এ সমস্ত কার্য সম্পাদন করে।
৭. অর্থ সংক্রান্ত কার্য : জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের বিবিধ কার্য সম্পাদনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। সাধারণত কর ধার্য ও সেবামূলক কার্যাদি সম্পাদন প্রভৃতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হয়। এক্ষেত্রে শাসন বিভাগই সরকারি অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয় নির্বাহ করে। তবে কর ধার্য ও ব্যয় বরাদ্দের ব্যাপারে আইনসভার অনুমোদন আবশ্যক। সরকারের অর্থ সংক্রান্ত কার্য শাসন বিভাগের অর্থ দপ্তরের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়।
৮. জনকল্যাণমূলক কার্য : সাম্প্রতিককালে প্রতিটি রাষ্ট্র জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করেছে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই শাসন বিভাগের কার্যগত পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে বর্তমানে শাসন বিভাগকে জনশিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, পরিবহন, শিল্প-বাণিজ্য, ডাক ও তার এবং অন্যান্য সেবামূলক বহুবিধ কার্যাদি সম্পাদন করতে হয়।
৯. জনমত সৃষ্টি: শ্বাসন বিভাগ তাদের কর্মকাণ্ডের উপর জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেন। জনমত তাদের অনুকূলে থাকলে পরবর্তী নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব হয়। যে কারণে শাসন বিভাগের অন্যতম দায়িত্ব হলো তাদের কার্যক্রমের স্বপক্ষে জনমত তৈরি করা।
১০. রাজনৈতিক নেতৃত্ব । আধুনিককালে শাসন বিভাগকে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা রক্ষা কিংবা রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে শক্তিশালীরূপে গল্পে তোলার জন্য নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। সব ধরনের শাসনব্যবস্থায় নেতৃত্বের ভূমিকা কম নয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধানকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে হয়। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি দেশ ও জাতিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন।
১১. নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত কার্য : স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত কার্যাদি সম্পাদনের লক্ষ্যে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতি থাকতে হয়। সরকারের শাসন বিভাগ এই নীতি নির্ধারণ করে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ক্যাবিনেট এই নীতি প্রণয়ন করে থাকে।
১২. আইন বিভাগের নেতৃত্ব দান : সংসদীয় পদ্ধতিতে আইন বিভাগের সদস্যদের মধ্য হতে প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা পরোক্ষভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। প্রেসিডেন্ট সংসদে ভাষণ প্রদান, বাণী প্রেরণ এবং পাসকৃত আইনের অনুমোদন দিয়ে থাকেন। আর সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রধানমন্ত্রী তার দলের পক্ষে সংসদে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। বলা বাহুল্য, এরা সকলেই শাসন বিভাগের সদস্য।
১৩. সামরিক কার্যাদি : রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব শাসন বিভাগের উপর ন্যস্ত। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিটি রাষ্ট্রের শাসন বিভাগই সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তোলে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী এসব দেশের প্রেসিডেন্টগণ সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। ফলে সশস্ত্রবাহিনীর নিয়োগ, পদোন্নতি, সামরিক হার্ডওয়্যার সরবরাহ, সামরিক নীতি প্রণয়ন, যুদ্ধ ঘোষণা ইত্যাদি কাজসমূহ প্রেসিডেন্টগণ করে থাকেন। ব্রিটেনের শাসন বিভাগীয় প্রধান আইনসভার অনুমোদন ব্যতীত যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে ।
১৪. কূটনৈতিক কার্যক্রম : বর্তমান সময়ে কোনো রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। যে কারণে প্রতিটি রাষ্ট্রকে অপরাপর রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন এবং কূটনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। এ উদ্দেশ্যে প্রতিটি রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে এবং অপর রাষ্ট্র কর্তৃক নিজ দেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে গ্রহণ করে। এছাড়া রাষ্ট্রের শাসন বিভাগের কূটনৈতিক কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে সন্ধি-চুক্তি সম্পাদন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সম্পর্ক স্থাপন বা সদস্যপদ গ্রহণ ও সেখানে নিজ দেশের প্রতিনিধি প্রেরণ করা ।
১৫. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের নেতৃত্ব প্রদান : শাসন বিভাগের সদস্যরা অন্যান্য দেশে অনুষ্ঠিত সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, কৌশলগত ও সামরিক সম্মেলনে দেশের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ন্যাম, কমনওয়েলথ, ন্যাটো ইত্যাদি সম্মেলনে শাসন বিভাগের সদস্যরাই সাধারণত যোগদান করে থাকেন।
.
১৬. আন্তর্জাতিক সাহায্য : শাসন বিভাগ আন্তর্জাতিক মানবতার অংশ হিসেবে অনেক সময় বহির্বিশ্বে দুর্যোগের মুহূর্তে আর্তমানবতার সাহায্যে হস্ত সম্প্রসারণ করেন। এ উদ্দেশ্যে শাসন বিভাগ প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণসমাগ্রী প্রেরণ ও চিকিৎসা সহায়তা প্রেরণ করে থাকে।
১৭. বিবিধ কার্য : শাসন বিভাগ উল্লেখিত কার্যাবলি ব্যতীত কিছু কিছু বিবিধ কার্যক্রমও সম্পাদন করে থাকে। যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে প্রতীকীমূলক ও অনুদানমূলক কার্যক্রম। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি প্রতীকীমূলক কার্যাদি সম্পন্ন করেন। এক্ষেত্রে এ সকল পদাধিকারী ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন ও সমাবর্তনে ভাষণ প্রদান করেন এবং রাষ্ট্রীয় পদক ও উপাধি বিতরণ করেন। এ সকল কার্যাবলি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বৃদ্ধি করে।