গণতন্ত্র কেবল সরকার ব্যবস্থাই

বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র একটি সর্বজন গৃহীত উপযোগী শাসন পদ্ধতি। উন্নয়নশীল বিশ্বে যেখানে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর আধিপত্য একটি অনিবার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছিল সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রভাব অস্বীকার করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য গণতন্ত্র আজ সর্বাধিক আলোচনা ও গবেষণার বিষয় হয়েছে।

লিন্ডসে ( A. D. Lindsay) মনে করেন, “Democracy is a theory of society as well as a theory of government.” অর্থাৎ, গণতন্ত্র যেমন একটি সামাজিক তত্ত্ব, তেমনি সরকার তত্ত্বও বটে। তিনি বলেন, যদি রাষ্ট্রের লক্ষ হয় সমাজ ও সম্প্রদায়ের সেবা করা এবং আরও উন্নত পর্যায়ে উত্তরণ ঘটানো তবে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক জীবনের কতগুলো নীতিমালা অবশ্যই মেনে চলবে। তিনি আরও বলেন, “গণতান্ত্রিক শাসনের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজের সাধারণ জীবনের সহায়তা করা এবং এরূপ জীবনযাত্রার ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী সকল অসংগতি দূর করা।

গণতন্ত্র সম্পর্কে লিন্ডসের ধারণাসমূহের বিশ্লেষণে দু’ধরনের অর্থ বেরিয়ে আসে। প্রথমত গণতন্ত্র একটি সামাজিক এবং দ্বিতীয়ত গণতন্ত্র একটি সরকার তত্ত্ব।


সামাজিক তত্ত্ব হিসেবে গণতন্ত্র
Democracy as Social Theory

১. একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজ নাগরিক কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে। এই অংশগ্রহণ সাম্যভিত্তিক। এখানে সকল মানুষেরই গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সমান। সুখে-দুঃখে বিপদে-আপদে সকলেই সমান অংশীদার।

২. স্বাধীনতা : গণতান্ত্রিক সমাজ অবাধ ও মুক্ত সমাজ, তবে স্বেচ্ছাচারি নয়। এখানে ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার পাশাপাশি কাজ করার ও কাজ পাবার স্বাধীনতাও রয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার সার্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে জনগণের এসব অধিকার রক্ষায় আগ্রহী।

৩. কল্যাণমূলক সরকার : কল্যাণমূলক সরকারের ধারণা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতিভূ। গণতান্ত্রিক সমাজই কেবল পারে কল্যাণকামি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে।

৪. আইনের শাসন : গণতান্ত্রিক সমাজ সকলের প্রতি সমান ব্যবহার করবে এবং নৈর্ব্যক্তিকতার মধ্য দিয়েও এ আইন কার্যকর হবে। আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় পদ্ধতিই অনুসৃত। “Due process of law” ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকেই বিনা কারণে নিগৃহীত ও অত্যাচারিত করা যাবে না— এটাই গণতান্ত্রিক সমাজের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।

৫. সহিষ্ণুতা : সহিষ্ণুতা গণতন্ত্রের একটি অন্যতম উজ্জ্বলতম আদর্শ। গণতন্ত্রের যে মাহাত্ম্য তা তাঁর সামাজিক জীবনে সহিষ্ণুতার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। মতামত প্রকাশে এখানে সকলেই সংযত ও সহিষ্ণু হবে। এখানে Argument of force নয়, বরং Force of Argument হবে প্রধান নিয়ামক শক্তি। অস্ত্র বা ক্ষমতার দাপট গণতন্ত্রের এ মূল্যবোধকে শুধুই পর্যুদস্ত করে। সরকার পরিবর্তনে বুলেট নয়, ব্যালটই একমাত্র কাম্য ।

৬. সার্বজনীনতা : গণতান্ত্রিক সমাজ সার্বজনীন সমাজ। গণতন্ত্রে আইনের চোখে সকলেই সমান। ধন সম্পদ নয় বরং মানুষ হিসেবে মানুষের মূল্যায়ন ও প্রতিপালনই সার্বজনীন আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত থাকবে ।

. সৌহার্দ্য : “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে” এটিই হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম সামাজিক মূল্যবোধ। একের প্রতি অন্যের দরদ, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা সমাজে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে যা কেবল গণতান্ত্রিক সমাজ থেকেই আশা করা যায়।

৮. ন্যায়বিচার : প্রতিভা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে মানুষের মূল্যায়ন গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আরোপিত গুণ নয়, বরং অর্জিত যোগ্যতাই মানুষের কর্ম ও সাফল্যের শর্ত হিসেবে বিবেচিত হয় ।

৯. যুক্তিবাদ : মানুষ মাত্রই বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন জীব। মানুষের যুক্তিযুক্ত ও সংযত আলাপ-আলোচনা ও সম্মতিই গণতান্ত্রিক সরকারের ভিত্তি।

সরকার তত্ত্ব হিসেবে গণতন্ত্র
Democracy as Government Theory

১. সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব : শাসনব্যবস্থায় সকল প্রকার ধর্ম, বর্ণ, গোত্র বা গোষ্ঠীর সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে গণতন্ত্র মানুষের মাঝে বিরাজমান সকল প্রকার ব্যবধানের বিলোপ সাধন করে থাকে।

২. নিয়মতান্ত্রিক সরকার : আইন ও রাজনৈতিক বিধিনিষেধ এবং জনগণ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নিকট জবাবদিহিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত নিয়মতান্ত্রিক সরকার কেবলমাত্র গণতন্ত্রেই সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর এর ব্যর্থতাই সোভিয়েত সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ।

. সংবিধানের প্রাধান্য : গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতিতে জাতীয়, আন্তঃরাষ্ট্রীয় কিংবা আন্তঃআঞ্চলিক সমস্যা সমাধানে সংবিধানই হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী কর্তৃপক্ষ। সাংবিধানিক আইন অলঙ্ঘনীয় ও পবিত্র বলে বিবেচিত হয় ।

  1. সংসদীয় সার্বভৌমত্ব : সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার সংসদের মাধ্যমে জনগণের নিকট দায়িত্বশীল থাকে। আইন বিভাগের প্রতি নির্ভরশীলতা সরকারকে দায়িত্বশীল হবার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু স্বৈরতন্ত্র ঠিক এর বিপরীত ।

. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ: সাধারণ অবস্থায় সরকারের তিনটি বিভাগ একে অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ না করা এবং প্রয়োজনে জনস্বার্থ রক্ষার্থে ভারসাম্য রক্ষা করার নীতি গণতান্ত্রিক সরকার তত্ত্বের অন্যতম দিক।

৬. শক্তিশালী বিরোধী দল : গণতান্ত্রিক সমাজ কিংবা সরকার উভয়ের সফলতার ক্ষেত্রে শক্তিশালী বিরোধী দলের অস্তিত্ব দেখা যায়। সরকার তাঁর সাফল্যের প্রয়োজনে বিরোধী দলকে প্রতিপালন করে থাকে। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রে এ প্রমাণ মেলে না।

৭. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : জনগণের অধিকার এবং মানব প্রগতি নিশ্চিতকরণের জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কার্যরত থাকবে ।

. সার্বজনীন ভোটাধিকার : আধুনিক গণতন্ত্রে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধিগণ নির্বাচিত হয়ে আসেন। উপরের আলোচনায় তত্ত্ব হিসেবে আমরা গণতন্ত্রকে সরকার ও সমাজব্যবস্থার প্রধান নিয়ামক হিসেবে দেখতে পাই। তাই এ পর্যায়ে দ্বিধাহীন চিত্তেই আমরা লিন্ডসের উক্তিকে স্মরণ করে এটাকে যুগপৎভাবে সরকার ও সামাজিক তত্ত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারি। তবে অনগ্রসর ও অশিক্ষিত সমাজে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মাঝে গণতন্ত্রের এ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।

Leave a Reply