গণতন্ত্রের সফলতার শর্তাবলি Pre-conditions for the Success of Democracy
গণতন্ত্রে যদিও মানব সাম্য, গণসার্বভৌমত্ব, আইনের শাসন এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ পরিলক্ষিত হয় তবুও এটি সফল করা বেশ কষ্টকর। তাই হেনরী মেইন বলেছেন, “সরকারের অন্যান্য শ্রেণিবিভাগের তুলনায় গণতন্ত্র সফল করা সবচেয়ে কঠিন।” নিম্নে গণতন্ত্রের সফলতার জন্য কতিপয় শর্তের সুপারিশ করা হলো :
১. জনগণের ইচ্ছা ও সামর্থ্য/ গণতান্ত্রিক জনগণ : গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য প্রয়োজন গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আগ্রহ এবং একে প্রতিপালন করার সামর্থ্য। জনগণ গণতন্ত্র না চাইলে সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা না করাই ভালো। অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন নাগরিকগণই গণতান্ত্রিক হিসেবে বিবেচিত হন, যারা জনসাধারণের স্বার্থরক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
২. ব্যাপক শিক্ষা / সুশিক্ষা : গণতন্ত্রের সফলতার জন্য ব্যাপক শিক্ষা তথা সুশিক্ষার প্রচলন করতে হবে। কেননা, শিক্ষা মানুষকে যেমন আত্মসচেতন, আত্মমর্যাদাবান, অন্যের প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠ ও অধিকার সচেতন করে তোলে, তেমনি সরকারের ভুল-ত্রুটি অনুধাবন করার সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করে। যে কারণে, বিনামূল্যে বা বাধ্যতামূলক শিক্ষাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন গণতান্ত্রিক ধারণার সাথে মানানসই শিক্ষা কার্যক্রম। এক্ষেত্রে বলা হয়, “সার্বজনীন ভোটাধিকারের স্বীকৃতির পূর্বে সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা আবশ্যক।”
৩. গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য : অনেকে আবার গণতন্ত্রের সাফল্যের স্বার্থে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে থাকেন। গণতন্ত্র কখনো চর্চা করা হয়নি এমন দেশে গণতন্ত্র সফল নাও হতে পারে। এজন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য। গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য না থাকলে দেশের মানুষ গণতন্ত্রের স্বরূপ ও সার্থকতা যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারে না।
৪. লিখিত সংবিধান : গণতন্ত্রের সফলতার জন্য লিখিত সংবিধান অপরিহার্য। কেননা, সংবিধান লিখিত হলে সাধারণ জনগণ নিজেদের অধিকার ও কর্তব্য এবং সরকারি ক্ষমতার সীমা প্রভৃতি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত থাকে। ফলে সরকার সহজে স্বৈরাচার হতে পারে না।
৫. আইনের অনুশাসন : গণতন্ত্রের সফলতার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ, “সকলেই আইনের দৃষ্টিতে সমান” (All are equal before law) এ নীতির বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আইনের ফাঁক দিয়ে যদি সমাজের রাঘব বোয়ালরা বের হয়ে যায় আর সাধারণ জনগণ এর ফাঁদে আটকে পড়ে তবে গণতন্ত্র সফল হবে না ।
৬. সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি : আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রে সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল জনমত গঠন করে ক্ষমতাসীন হয়। আবার ক্ষমতাসীন দল যাতে করে জনস্বার্থ বিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত হতে না পারে বিরোধী দল সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখে।
৭. উপযুক্ত বা সুযোগ্য নেতৃত্ব : সৎ, দক্ষ ও সুনিপুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে গণতন্ত্র সফল হয়। সমাজ বা রাষ্ট্রের সমস্যাবলি কী কী এবং কোন কোন পথে এসব সমস্যার সমাধান আসতে পারে, সে সম্পর্কে রাজনৈতিক নেতাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি থাকতে হবে। কেননা, অদক্ষ ও অসৎ নেতৃত্ব কোনো দিনই সফল হতে পারে না।
৮. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : বর্তমানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা হলো গণতন্ত্রের সফলতার অন্যতম পূর্বশর্ত। বিচার বিভাগকে সরকারের অন্যান্য বিভাগের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। অন্যথায় বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে।
৯. মুক্ত ও স্বাধীন প্রচার মাধ্যম : গণতন্ত্রের সফলতার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো মুক্ত ও স্বাধীন প্রচার মাধ্যমের একান্ত উপস্থিতি । কেননা, রাষ্ট্রের প্রচার মাধ্যমসমূহ যেমন : সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, রাজনৈতিক মঞ্চ ইত্যাদি ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলের মতামত প্রকাশের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। তবে এক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিক নীতি ও পদ্ধতি অবশ্যই পালন করতে হবে।
১০. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ : গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতিকে অন্যতম পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। কেননা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ক্ষমতা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। তাছাড়া বিকেন্দ্রীকরণের দ্বারা স্থানীয় শাসনকে শক্তিশালী করা যায়। আবার, স্বায়ত্তশাসনমূলক স্থানীয় শাসন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে ।
১১. অর্থনৈতিক সাম্য : অর্থনৈতিক সাম্য গণতন্ত্রের সফলতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। লাস্কির মতে, “অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত গণতন্ত্র সফল হতে পারে না।” কেননা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকলে জনগণের মুখে হাসি ফোটে। তারা গণতন্ত্র রক্ষায় এগিয়ে আসে। এলডাস হাক্সলী (Huxely) তাই বলেছেন, “অর্থনৈতিক দাসত্বের বিরুদ্ধে জনগণকে নিরাপত্তা দিতে হবে। তাহলে গণতন্ত্র সফলতার দিকে এগিয়ে যাবে।”
১২. সামাজিক সাম্য : গণতন্ত্রকে সফল করে তুলতে হলে, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে সকলকে যোগ্যতা অনুসারে সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে বলেন, “মানব প্রকৃতির উপর যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ার কারণেই গণতন্ত্র ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়।”
১৩. সহনশীলতা/ পরমতসহিষ্ণুতা : গণতন্ত্রের প্রাণ হলো সহনশীলতা বা পরমতসহিষ্ণুতা। যে কারণে, গণতন্ত্রের সফলতার জন্য দল ও মত নির্বিশেষে সকলকে সহনশীল হতে হবে। নিজের মতামত প্রকাশ করার এবং অপরের মতামতকে সহ্য করার মতো মানসিকতা না থাকলে গণতন্ত্র সফল হতে পারে না ।
১৪. সুষ্ঠু জনমত : জনমত ছাড়া গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না। তাই সুষ্ঠু জনমত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য। সরকার জনমতের উপর শ্রদ্ধাশীল থাকে এবং জনমতই সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে।
১৫. দায়িত্বশীলতা : দায়িত্বশীলতা গণতন্ত্রের পথকে সুগম করে। সরকার দায়িত্বশীল হলে জনগণের অধিকার, সাম্য ও স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয় না। পাশাপাশি জনগণ নিজেদের মধ্যে যাতে করে সৌভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রী স্থাপন করতে পারে, সেজন্যে জনগণের মধ্যে সামাজিক দায়িত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। এভাবে সরকার ও জনগণ উভয়েই দায়িত্বশীল হলে গণতন্ত্র সফল হয়।
১৬. জনগণের সাহস ও ইস্পাত কঠিন মনোবল : গণতন্ত্রের পথে বিভিন্নমুখি বাধা আসতে পারে। জনগণকে সে সমস্ত বাধা অতিক্রম করার শক্তি ও সাহসের অধিকারী হতে হবে। তাদেরকে সদা সতর্ক থাকতে হবে, নতুবা গণতন্ত্র একনায়কতন্ত্রের রূপ নেবে । * এছাড়াও গণতন্ত্রকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য যে সমস্ত পূর্বশর্তের প্রয়োজন :
১৭. জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ ও কার্যক্রমে গণতান্ত্রিক চেতনাকে ধারণ করতে হবে।
১৮. দেশের জনগণকে ধর্ম-বর্ণ বা গোষ্ঠীগত দিক থেকে বিভাজন না করে তাদের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। ১৯. জনগণকে প্রয়োজনে ধৈর্যের পরিচয় প্রদান করে তাদের দাবি সংক্রান্ত বিষয়ে সমঝোতায় আসতে হবে।
২০. গণতন্ত্রের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে সরকারি কর্মচারীদের দক্ষতা ও উদ্যমশীলতার উৎকর্ষের উপর। কেননা, নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক নেতাগণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তাদের অনেকের সরকারি কার্যপরিচালনায় কোনো প্রকার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে স্বভাবতই তাদেরকে সরকারি কর্মচারীদের উপর নির্ভর করতে হয়। ২১. গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে জনগণের সজাগ দৃষ্টিভঙ্গির উপর । লাস্কির মতে, “স্বাধীনতার মূল্য জনগণের সজাগ দৃষ্টি।” ২২. গণতন্ত্রের সফলতার জন্য সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকা দরকার ।
২৩. গণতন্ত্রের সফলতা জাতীয় সংহতি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার উপর নির্ভরশীল।
এছাড়াও জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill) গণতন্ত্রের সফলতার জন্য তিনটি শর্তের কথা বলেছেন :
ক. জনগণের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গ্রহণের ইচ্ছা থাকবে ।
খ. গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য জনগণ প্রয়োজনীয় কর্তব্য পালনে ইচ্ছুক ও সক্ষম হবেন ।
গ. গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অপরিহার্য কার্য সম্পাদনে জনগণ সম্মত ও সমর্থ হব