Table of Contents
Toggleগণতন্ত্রের অর্থ ও সংজ্ঞা Meaning & Definition of Democracy
গণতন্ত্র প্রত্যয়টি যুগ যুগ ধরে আলোচিত ও বিশ্লেষিত হয়ে আসছে এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের জ্ঞান ও চিন্তাজগতে তুমুলভাবে আলোড়িত করছে। সুপ্রাচীনকালে বিশেষত প্রাচীন গ্রিসের রাষ্ট্রদর্শনে এর উৎপত্তি লক্ষ করা যায়। গণতন্ত্র জনগণের সর্বসম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এটি জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার এবং জনগণের অধিকার রক্ষাসহ সার্বিক বিকাশে একান্ত সহায়ক। কাজেই আধুনিক যুগে গণতন্ত্রের জয়জয়কার সর্বত্র লক্ষণীয়। যে কারণে বর্তমান যুগকে গণতান্ত্রিক যুগ বললেও অত্যুক্তি হবে না। জে. এস. মিল (JS. Mill) গণতন্ত্রকে “Great discovery of modern times” বলে অভিহিত করেছেন ।
গণতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো “Democracy” যা গ্রিক শব্দ Demos এবং Kratia/ Kratos থেকে এসেছে। Demos শব্দের অর্থ ‘জনগণ’ আর Kratia / Kratos শব্দের অর্থ ‘ক্ষমতা’। সুতরাং উৎপত্তিগত অর্থে ও বিবেচনায় গণতন্ত্রের অর্থ দাঁড়ায় জনগণের ক্ষমতা ।
কিন্তু পারিভাষিক দিক থেকে গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায় তা একবাক্যে বলা মুশকিল। কেননা, গণতন্ত্রের রূপ, প্রকৃতি ও ধরন স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এতই ভিন্ন যে, এর সংজ্ঞাও বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্নভাবে প্রদান করেছেন। যেমন—
১৯৬৫ সালে গেটিসবার্গের বক্তৃতায় দেয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ( Abraham Lincoln)-এর গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটি বেশ জনপ্রিয় । তাঁর মতে, “Democracy is a government of the people by the people and for the people”.
১. ফরাসি দার্শনিক রুশোর (Rousseau) সংজ্ঞায় আইনের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। রুশোর মতে, “গণতন্ত্র তাকেই বলা হয়, যা আইনের ভিত্তিমূলে প্রতিষ্ঠিত।”
২. অধ্যাপক ম্যাকাইভার (Prof. Maclver) তাঁর ” Web of Government” গ্রন্থে গণতন্ত্রের একটি চমৎকার সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতে, “গণতন্ত্র এমন এক শাসনব্যবস্থা যা সংখ্যাগরিষ্ঠ বা অন্য কারো দ্বারা পরিচালিত পদ্ধতি নয় বরং কে শাসন করবে এবং কোন উদ্দেশ্যে শাসন করবে তা নির্ধারণের উপায় মাত্র । “
৩. গণতন্ত্রের আধুনিক পিতা বলে খ্যাত জন লক (John Locke ) গণতন্ত্রের অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতে, “Consent is the basis of modern democracy.”
৪. অধ্যাপক গেটেল (Prof. Gettell) বলেন, “যেখানে শাসনব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগে অংশ নেওয়ার অধিকারী তাই গণতন্ত্র । “
৫. সি. এফ. স্ট্রং (C. F. Strong) বলেন, “যেখানে শাসনব্যবস্থা শাসিতের সক্রিয় সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত তাই গণতন্ত্র।”
৬. অধ্যাপক ডাইসী (Prof. Diecy)-এর মতে, “গণতন্ত্র হচ্ছে এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে শাসকবর্গ তুলনামূলকভাবে জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ।”
৭. অধ্যাপক সিলি (Prof. Seely)-এর মতে, “Democracy is a form of government in which everyone has a share”. ৮. লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেন, “Democracy is a government in which the will of the majority of the qualified citizen rules………… say at least three-fourths so that physical force of the citizen coincides with their voting power.”
৯. সমাজবিজ্ঞানী গিডিংস (Giddings)-এর মতানুসারে, “Democracy may either be a form of government, a form of state, a form of society of a combination of all the three.”
সুতরাং বলা যায় যে, গণতন্ত্র এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা যাতে জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং ক্ষমতার উৎস, এর স্থায়িত্বকরণ এবং দেশ পরিচালনায় জনগণ ও তাদের সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় ।
গণতন্ত্রের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
Origin and Development of democracy
গণতন্ত্র একটি প্রাচীন ধারণা। প্রাচীনকালে গ্রিস দেশে সর্বপ্রথম এ ধারণার সৃষ্টি হয়। কালক্রমে এ ধারণা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দি থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত গণতন্ত্রের বিকাশ অব্যাহত আছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ‘গণতন্ত্র’ শব্দটিকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হতে দেখা যায়। এ কারণে ম্যাবট (Maboot) বলেন, “Democracy is the most elusive and ambiguous of all political terms.”
১. প্রাচীন যুগ (Ancient Period) :
ক. প্রাচীন গ্রিসে সর্বপ্রথম গণতন্ত্রের ধারণার উৎপত্তি : খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে সর্বপ্রথম গ্রিকরা ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করে। গ্রিস দেশের এথেন্স নগরীতে সর্বপ্রথম পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলকভাবে গণতন্ত্রের সূত্রপাত ঘটে। গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডাইডস (Thucydides) তাঁর পোলোপোনেসীর যুদ্ধের ইতিহাস নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম গণতন্ত্র (Democracy) শব্দটি ব্যবহার করেন। থুসিডাইডস (Thucydides) এর মতে, দার্শনিক পেরিক্লিস সরকারের এমন একটি রূপ হিসেবে গণতন্ত্রের কথা কল্পনা করেছিলেন, যেখানে সকল মানুষই আইনের ক্ষেত্রে সাম্য ভোগ করবে এবং যেখানে কর্মচারীরা শ্রেণিগত ভিত্তি অপেক্ষা গুণগত ভিত্তিতে নিযুক্ত হবেন। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে হেরোডোটাস ( Herodotus) নামে এক
গ্রিক ঐতিহাসিক গণতন্ত্র সংক্রান্ত আলোচনায় “বহুজনের শাসন” এবং সমাজে সমঅধিকারের কথা বলেছেন। এ সময় অপর একজন গ্রিক দার্শনিক ক্লিওন (Cleon) গণতন্ত্রকে জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন বলে উল্লেখ করেন। প্লেটো ও এরিস্টটলের আমলে গণতন্ত্র শ্রেণি শাসনব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেনি। এ সময় গণতন্ত্র বলতে জনতাতন্ত্ৰ (Mobocracy) কে বোঝানো হতো এবং তা নিকৃষ্ট শাসন ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হতো।
খ. প্রাচীন ভারত : প্রাচীনকালে গ্রিস ও রোমের মতো ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের ধারণার সৃষ্টি হয়। বৈদিক যুগে ও পৌরাণিক যুগে ‘সভা সমিতি’ নামে প্রভৃতি গণতান্ত্রিক সংস্থার অস্তিত্ব ছিল। সেই সময় প্রজা সাধারণের বিশেষ অধিকারের স্বীকৃতি ছিল। এ বিষয়ে পৌরাণিক যুগের ধর্মগ্রন্থসমূহে উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন ভারতের গ্রামীণ সমাজে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিধান ছিল। গ. প্রাচীন রোম : প্রাচীন রোমে রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল। রাজতন্ত্রের অবসানের পরে প্যাট্রিসিনস (Patricians) দের সাথে তাদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ফলশ্রুতিতে উভয় পক্ষই সমানাধিকারের সুযোগ লাভ করে এবং সমসাময়িক শাসন ব্যবস্থা অভিজাততন্ত্র, রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের এক সমন্বিত রূপ ধারণ করে।
ঘ. স্টোয়িকদের অবদান : গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার বিকাশে গ্রিক স্টোয়িকদের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরা ব্যক্তির স্বাভাবিক সাম্য, আইন অনুযায়ী চলার প্রবণতা ও ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধের কথা বলেছেন। পরবর্তীকালে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের বিকাশে রোমান আইনের দমন ও প্রভাব দেখা যায়। এ সময় রোমে অভিজাত শ্রেণির শাসন কায়েম হয়।
২. মধ্যযুগ (Mediaeval Period) : মধ্যযুগে সমগ্র ইউরোপে সামন্তবাদী চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটে। তখন গির্জা ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়ে। এ সময়ে সর্বজনীন আইনের কর্তৃত্ব গির্জার উপর ন্যস্ত হয়। গির্জার ভাষায় “If anybody wants to become a member of the state, before it has to be a member of Church”. f মধ্যযুগে ১২১৫ সালে সামন্তদের চাপের মুখে রাজা জন ঐতিহাসিক মহাসনদ (The Magna Carta) এ স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এর মাধ্যমে ব্রিটেনে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার পথ সুগম হতে থাকে। ১৬৮৮ সালে ব্রিটেনে গৌরবময় বিপ্লস (Glorious Revolution) সংঘটিত হয়। ১৬৮৯ সালে অধিকারের বিল (Bill of Rights) পাসের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ও পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩. আধুনিক যুগ (Modern Period) : ১৭৭৬ সালের আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব আধুনিক গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণার বিকাশে সহায়তা করেছে। আধুনিক অর্থে গণতান্ত্রিক ধারণার সূত্রপাত ঘটে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও পুঁজিবাদী যুগের সূত্রপাতের সময় থেকে। এ সময় সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি গণতান্ত্রিক আদর্শ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ক. উদানৈতিক গণতন্ত্রের সূত্রপাত ও বিকাশ : মূলত সপ্তদশ শতাব্দিতে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সূত্রপাত ঘটে। অষ্টাদশ শতাব্দির শেষ দিক গণতন্ত্র ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, উপযোগবাদ ও উদারতাবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং উদানৈতিক গণতন্ত্ৰ নামে পরিচিতি লাভ করে। চুক্তিবাদী দার্শনিক হবস (Hobbos), লক (Locke) ও রুশো (Rousseau)-র লেখনীর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা সমৃদ্ধ হয়। বেন্থাম (Bentham), জেমস মিল (James Mill) ও জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill) এর লেখনীর মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ও উপযোগবাদী চিন্তাচেতনা বিকশিত হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং উপযোগবাদ উদারনৈতিক গণতন্ত্রের পিছনে সমর্থন যুগিয়েছে। জন স্টুয়ার্ট মিল প্রাপ্ত ভোটাধিকার ও নারীর ভোটাধিকারের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন। বিংশ শতাব্দিতে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের বিকাশে টি এইচ গ্রিন, হার্বার্ট স্পেনসার, হ্যারল্ড জে লাস্কি, অধ্যাপক আর এম ম্যাকাইভার, বার্কার প্রমুখ লেখক অবদান রেখেছেন। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন, জেমস ম্যাডিসন এবং আব্রাহাম লিংকন এর নাম বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। –
খ. সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ : ১৯১৭ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে গণতন্ত্র নতুন এক রূপ ধারণ করে। এ সময় গণতন্ত্রের উদারনৈতিক ভাবধারার পাশাপাশি একটি সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়, একে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র (Socialist Democracy) বলা হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রে সমাজের সকল শ্রেণির স্বার্থ রক্ষিত হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ত্রুটি থেকে মুক্ত। লেনিন (V.L. Lenin) সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র সম্পর্কে বলেল, “It is a political system which gives the maximum of democracy for the workers and peasants at the same time.”
গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য Characteristics of Democracy
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কল্যাণধর্মী শাসনব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের স্বরূপ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে এর কতগুলো বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়। যেমন :
১. নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিয়মতান্ত্রিকতায় বিশ্বাস করে। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকার বাছাই এবং পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, নিয়মনীতির মাধ্যমেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয় ।
আইনের অনুশাসন : গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আইনের অনুশাসন। যে কারণে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জাতি, গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে আইনের চোখে সকলেই সমান। তাছাড়া এ ব্যবস্থায় ব্যক্তির শাসনের পরিবর্তে আইনের শাসনের প্রাধান্য দেয়া হয়।
৩. জনগণের সার্বভৌমত্ব : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণই প্রকৃত সার্বভৌমত্বের অধিকারী। এ ব্যবস্থায় জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করে। এ প্রসঙ্গে মনীষী লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেন, “Popular sovereignty has become the basis and watch of democracy.”
৪. দায়িত্বশীল বা জবাবদিহিতামূলক শাসনব্যবস্থা : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় শাসকগণ তাদের সকল প্রকার দায়িত্ব ও কাজের জন্য জনগণের নিকট প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়িত্বশীল থাকেন। যে কারণে সরকারের দায়িত্বশীল প্রত্যেককে তার কাজের জন্য জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে হয়।
৫. সংবিধানের প্রাধান্য : আধুনিক উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংবিধানকে দেশের মৌলিক আইন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। সরকারের তিনটি বিভাগ এবং যে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব মেনেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। কেউই সংবিধানের ঊর্ধ্বে অবস্থান করতে পারে না। মার্কিন সংবিধানের ৬নং ধারায় সংবিধানকে “দেশের সর্বোচ্চ আইন” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
জনমতের প্রাধান্য : গণতন্ত্রে জনগণই হলো সকল ক্ষমতার উৎস বা মালিক। যে কারণে জনমতকে এ ব্যবস্থায় সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। জনমতের উপর গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপিত হয় ।
৭. বহুদলীয় ব্যবস্থা : বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ ধরনের শাসনব্যবস্থার প্রাণ হচ্ছে বহুসংখ্যক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি। কারণ বহুদলীয় ব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজের সমকালীন সমস্যাবলি সম্পর্কে আলোচনা করায় নাগরিকদের রাজনৈতিক জ্ঞান যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি আবার ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদলের সমালোচনা করে তাকে সংযত রাখে। আর এতে করে গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় থাকে । বার্কার-এর ন্যায় উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তারা একদলীয় ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের হন্তাকারক হিসেবে মনে করেন।
ভোটাধিকার : সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারকে গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে মনে করা হয়। ভোটাধিকারের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের আদর্শ ও ভিত্তি স্থাপিত হয়। জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে এটি একটি অনন্য পদ্ধতিও বটে ।
৯. বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা : বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত। গণতন্ত্রে বিচার বিভাগ সুষ্ঠু, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে। রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগ বিচার বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
১০. সামাজিক ঐক্য ও সাম্য : গণতন্ত্রে সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও সুযোগ বিদ্যমান। এ ব্যবস্থায় দল, মত, নারী- পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ, বংশ ও পদমর্যাদা নির্বিশেষে সকল নাগরিককে সমান মর্যাদা প্রদান করা হয় এবং সামাজিক সুযোগ- সুবিধা সমানভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়।
১১. সমন্বয় সাধন ও সমঝোতা : সমন্বয় সাধন ও সমঝোতা হলো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন দল ও মতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়ে থাকে। কোনো প্রকার সমন্বয় ও সহযোগিতা ব্যতীত গণতন্ত্র অচল ।
নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ : গণতন্ত্রে নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়। এ ব্যবস্থায় নাগরিকের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারসমূহকে স্বীকার করা হয় এবং এ সকল অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয় । ১৩. সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন : গণতন্ত্র হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনব্যবস্থা। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে।
১৪. গঠনমূলক সমালোচনা : গঠনমূলক সমালোচনা গণতন্ত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের পাশাপাশি বিরোধী দলও সরকারের সমালোচনা করতে পারে। সরকারের যৌক্তিক সমালোচনা করলে সরকার যথার্থভাবে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়। দলমত নির্বিশেষে সকলের সমালোচনা এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় স্বীকৃত।
১৫. সাংবিধানিক উপায়ে সরকার পরিবর্তন : গণতন্ত্র সাংবিধানিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকারের পরিবর্তন সাধনে পক্ষপাতি। সরকার নির্বাচনের চরম ক্ষমতা জনগণের হাতে অর্পিত থাকায় যে কোনো সময় তারা একটি সরকারের পরিবর্তে অন্য আরেকটি সরকারকে ক্ষমতাসীন করতে পারে। যে কারণে গণতন্ত্রপন্থীরা বৈপ্লবিক উপায়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দখলের যে কোনো প্রচেষ্টাকে কঠোরভাবে সমালোচনা করে থাকেন।
১৬. স্বার্থগোষ্ঠীর প্রভাব : গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বণিক সংঘ শ্রমিক সংঘ, কৃষক সমিতি, মহিলা সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ন, যুব সংঘ প্রভৃতি নানা ধরনের চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী বা স্বার্থগোষ্ঠীর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করা যায়। এ সকল গোষ্ঠী নিজেরা প্রত্যক্ষভাবে সরকার গঠনে ইচ্ছুক না হলেও নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সরকারের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়াকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে সচেষ্ট থাকে।
১৭. আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য : আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। এ ব্যবস্থায় আমলারা কেবল শাসন বিভাগের উপর নিজেদের সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণই প্রতিষ্ঠা করে না, সেই সাথে আইনসভার সদস্যদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আইন প্রণয়ন কাজেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
১৮. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা : উদারনৈতিক গণতন্ত্রে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার স্বাধীনতা স্বীকৃতি লাভ করে। এসকল মাধ্যমের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় জনগণের অভাব-অভিযোগ, মতামত, সরকারি কাজ-কর্মের সমালোচনা প্রভৃতি বিনা বাধায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে পারে। ফলে সরকার জনমত হারানোর ভয়ে সাধারণত স্বৈরাচারি আচরণ পরিত্যাগ করে। ১৯. ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদের বিরোধিতা : প্রকৃত উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে কোনো ধরনের সর্বাত্মবাদের বিরোধিতা করে । অন্যভাবে বলা যায় যে, এর ফলে গণতন্ত্র যেমন নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের তীব্র সমালোচনা করে, অন্যদিকে তেমনি সাম্যবাদেরও চরম বিরোধিতা করে। যে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ জার্মানি ও ইতালির নাৎসীবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল।
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ গণতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এসকল বৈশিষ্ট্যের যে কোনো এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্যকে বাদ দিয়ে অর্থবহ গণতন্ত্রকে কল্পনা করা যায় না। যে কারণে গণতন্ত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করার জন্য এসকল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে হবে।