House of Commons
Table of Contents
Toggleকমন্সসভা House of Commons
কমন্সসভা House of Commons
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষই হলো কমগসভা। এই কমন্সসভাকে সাধারণত জনগ্রতিনিধিত্বমূলক কক্ষ বলা হয়। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে এই কক্ষ গঠিত। ১৮৩২, ১৮৬৭ ও ১৮৮৪ সালের সংস্কার আইন (Reform Act) গুলোর ভিত্তিতে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা গণতন্ত্রসম্মত করার ব্যাপারে উদ্যোগ গৃহীত হয়। আগে সম্পত্তিগত যোগ্যতার ভিত্তিতে কম সভার সদস্য হওয়ার ব্যবস্থা প্রচলন ছিল। ১৮৫৮ সালে এই সামন্ত্রতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। ১৯১৮ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের মাধমে ২১ বছর বয়স্ক পুরুষদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় এবং ৩০ বছর বয়সী বা তদূর্ধ্ব নারীদের ভোটাধিকার দেয়া হয়। ১৯২৮ সালে আরেকটি ভোটাধিকার আইন পাস করে পুরুষ ও নারীকে ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে সমান শর্তাধীন করা হয়। ১৯৪৮ সালে কমগসভায় জনপ্রতিনিধিত্ব আইন পাসের মাধ্যমে একই ভোটারের দুটি ভোটের অধিকার বাতিল করা হয়। ১৯৬৯ সালের সংশোধনী অনুযায়ী স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ১৮ বছর বয়স্ক প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়।
কমন্সসভার গঠন Composition of the House of Commons
প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমগসভা গঠিত হয়। বর্তমানে কমন্সসভার সদস্যসংখ্যা ৬৫০ জন। তারা একক ভোটার এলাকা থেকে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। ন্যূনতম ১৮ বছর হয়ত সকল ব্রিটিশ নাগরিক ভোটদানের অধিকারী। ১৯৪৫ সালে কমথসভার নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যা ছিল ৬৪০ জন। ১৯৪৮ সালে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুসারে কমপসভার সদস্য সংখ্যা ৬২৫ জনে নির্ধারিত করা হয়। ১৯৭৬ সালে কমপসভার সদস্য সংখ্যা ছিল ৬৩৫ জন। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে বাড়িয়ে ৬৫০ জন করা হয়।
কমলসভার সদস্যদের যোগ্যতা : কমন্সসভার সদস্যপদ প্রার্থীকে কতকগুলো যোগ্যতার অধিকারী হতে হয়, যথা-
ক. তাকে জন্মসূত্রে ও অনুমোদনসূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক হতে হবে;
খ. অদ্ভুত ২১ বছর বয়স্ক হতে হবে:
গ. যে কোনো ধর্ম বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সাধারণ আনুগত্যের শপথ নিতে হবে।
কমন্সসভার সদস্যপদ প্রার্থীদের অযোগ্যতা : ১৯৫৭ সালের কমন্সসভার অযোগ্যতা সংক্রান্ত আইন (House of Commons Disqualification Act, 1957) অনুযায়ী নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা কমন্সসভার সদস্য হতে পারেন না;
১. বিদেশি,
২. উন্মাদ,
৩. দেউলিয়া,
৪. দুর্নীতিসহ নির্দিষ্ট কিছু অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত ও কারারুদ্ধ ব্যক্তি,
৫. ধর্মযাজক,
৬. বিচারক
৭. আইরিশ পিয়ারগণ ছাড়া অন্যান্য পিয়ারগণ,
৮. সরকারি কর্মচারী,
৯. সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনীতে কর্মরত ব্যক্তিগণ ।
১৯৬৩ সালের পিয়ারেজ আইন (The Peerage Act, 1963) অনুযায়ী উত্তরাধিকার সূত্রে লর্ডসভার সদস্যপদ প্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি লর্ড উপাধি পরিত্যাগ করে কমন্সসভার সদস্যপদের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। ১৭০৫ সালের রাজ কর্মচারী আইন (Placement Act of 1709) অনুযায়ী রাজার অধীনে অর্থকরী পদে নিযুক্ত ব্যক্তি কমন্সসভার সদস্য হতে পারেন না।
নির্বাচনি এলাকা, জামানত ও অন্যান্য বিষয় : কমন্সসভার সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী সমগ্র দেশকে ভৌগোলিক নির্বাচনি এলাকায় বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক নির্বাচনি এলাকা থেকে একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন, প্রত্যক্ষ ও গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত কমন্সসভার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বৃহস্পতিবার। পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবার ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশিত হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রত্যেক প্রার্থীকে ১৫০ পাউন্ড জামানত রাখতে হয়। কোনো প্রার্থী মোট ভোট সংখ্যার কমপক্ষে এক-অষ্টমাংশ না পেলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। আবার কোনো প্রার্থী নির্বাচনে আইনানুমোদিত অর্থের বেশি খরচ করলে তার প্রার্থীতা বাতিল হয়ে যায়।
ঘ. ক্লোজার মোশন : ভোটাভুটি ছাড়া আলোচনা বন্ধের প্রস্তাব বা ক্লোজার মোশন (Closure Motion) এর মাধ্যমে কোনো বিষয়ের উপর আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে। কোনো বিষয়ের উপর দীর্ঘকাল যাবৎ আলোচনা চলতে থাকলে সভার যেকোনো সদস্য সেই বিষয়ে আলোচনা বন্ধের প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারেন। একেই আলোচনা বন্ধের প্রস্তাব বা Closure Motion বলা হয়। উপস্থিত অধিকাংশ সদস্য যদি প্রস্তাবটিকে সমর্থন করেন তাহলে কমন্সসভার স্পিকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর আলোচনা বন্ধ করে দেন। সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের কোনো সদস্যকে সরকারের পক্ষে এ ধরনের প্রস্তাব উত্থাপন করতে দেখা যায়। বিরোধী দলের সদস্যদের সরকার বিরোধী আলোচনার সুযোগকে সংকুচিত করার জন্য সরকারি দল এ ধরনের কৌশল অবলম্বন করেন।
ঘ. চতুর্থ পর্যায়, রিপোর্ট স্তর : সমগ্র কক্ষ কমিটিতে বিলটি যদি বিবেচিত হয় তবে রিপোর্ট পর্যায়ে কোনো তর্ক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় না। তবে বিলটি যদি কোনো স্থায়ী কমিটি বা সিলেক্ট কমিটি বিচার বিবেচনা করে সেক্ষেত্রে অবশ্যই কমন্সসভায় বিলটির উপর বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। রিপোর্টে বিচার–বিবেচনার প্রস্তাব গৃহীত হলে বিলটির বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে তর্ক–বিতর্ক এবং ভোটাভুটি হয়। কমিটি কর্তৃক প্রস্তাবিত সংশোধনের সুপারিশসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। প্রয়োজন বোধে নতুন নতুন সংশোধনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। কমগসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিলটির চূড়ান্ত রূপের পক্ষে বাধ্যতামূলক নয় । হার্ডে এবং ব্যাথার (Harvey & Bather) বলেছেন, “The bill in its final form, represents the opinion of the majority of the House and not merely that of the committee.”
৫. পঞ্চম পর্যায়, তৃতীয় পাঠ : রিপোর্ট পর্যায়ের পর শুরু হয় বিলের তৃতীয় পাঠ, বিলের তৃতীয় পাঠই হলো বিল পাসের চূড়ান্ত পর্যায়। এই পর্যায়ে প্রস্তাবক সংশ্লিষ্ট কক্ষে বিলটি গ্রহণের জন্য প্রস্তাব করেন। এই স্তরে বিলটির ধারা–উপধারা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না বা কোনো সংশোধনী প্রস্তাবও উত্থাপন করা যায় না। মৌখিক সংশোধনী প্রস্তাব আনা যেতে পারে। ব্যাকরণগত ভুল এবং কোনো শব্দ বাদ পড়লে বা উল্লেখযোগ্য অসঙ্গতি ধরা পড়লে সেগুলো সংশোধন করা যায়। এই পর্যায়ে বিলটিকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণ অথবা বর্জন করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন লাভ করলে বিলটি গৃহীত হয় ৷
চ. ষষ্ঠ পর্যায়, অন্য কক্ষের অনুমোদন : পার্লামেন্টের এক কক্ষে বিলটি গৃহীত হলে অপর কক্ষের অনুমোদনের জন্য সেটিকে পাঠানো হয়। সেই কক্ষে বিলটিকে অনুরূপ পদ্ধতিতে গৃহীত হতে হয়। যথাযথভাবে বিলটি অপরকক্ষে গৃহীত হলে ষষ্ঠ পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। উল্লেখ্য কোনো বিল কমন্সসভায় গৃহীত হবার পর লর্ডসভায় পাঠানো হয়। লর্ডসভায় একই পদ্ধতিতে বিলটি গৃহীত হলে তা রাজা বা রানীর সম্মতির জন্য প্রেরিত হয়। কেবল অর্থ বিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিল লর্ডসভা গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে। লর্ডসভার সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে কমন্সসভা আলোচনায় বসতে পারে। আবার কমন্সসভা সংশোধন প্রস্তাব নাকচ করতে পারে। ১৯৪৯ সালের পার্লামেন্ট আইন অনুযায়ী বর্তমানে কোনো পাবলিক বিল কমন্সসভার পর পর দুটি অধিবেশনে গৃহীত হলে এবং প্রথম অধিবেশনে বিলটির দ্বিতীয় পাঠ এবং দ্বিতীয় অধিবেশনে বিলের তৃতীয় পাঠের মধ্যে একবছর অতিক্রান্ত হলে লর্ডসভার অনুমোদন ছাড়াই বিলটিকে রাজা বা রানীর সম্মতির জন্য পাঠানো হয়।
ছ. সপ্তম পর্যায় : রাজা বা রানীর অনুমোদন : এই পর্যায়ে বিলটি রাজা বা রানীর সম্মতির জন্য প্রেরণ করা হয়, রাজা বা রানীর সম্মতি সম্পূর্ণরূপে আনুষ্ঠানিক কাজ মাত্র। একটি কমিশন আছে। এই কমিশন রাজা বা রানীর পক্ষে বিলে অনুমতি প্রদান করে। রাজা বা রানীর সম্মতির পর বিলটি আইনে পরিণত হয়। তবে রানী অ্যান (Ann) (১৭০৩) এরপর কোনো রাজা বা রানী পার্লামেন্ট কর্তৃক পাসকৃত বিলে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন নি।
অর্থবিল পাসের পদ্ধতি
Procedure of Passing Money Bills
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পার্লামেন্ট অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতার মাধ্যমে নিজেকে বর্তমান ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। কমন্সসভাই হলো ব্রিটিশ পার্লামেন্টের জনপ্রতিনিধিত্বমূলক কক্ষ। তাই অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমন্সসভাকেই দেয়া হয়েছে। অর্থবিল কেবল কমন্সসভায় উপস্থাপন করা যায় । আর্থিক বিষয়ে লর্ডসভার তেমন কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে ।
অর্থ বিলের সংজ্ঞা : ব্রিটেনে অর্থ বিল একটি পাবলিক বিল। ১৯১১ সালের পার্লামেন্ট আইনে অর্থ বিলের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, রাজস্ব আদায়, ব্যয় বরাদ্দ অনুমোদন, সরকারি ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ সংক্রান্ত বিলগুলো অর্থবিল হিসেবে গণ্য হবে। সাধারণ বিল এবং অর্থবিল পাসের ক্ষেত্রে আলাদা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে ।
অর্থ বিল সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় : অর্থ বিড়ো ব্যাপারে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে স্মরণ রাখা প্রয়োজন :
১. কেবল কমন্সসভাতেই অর্থ বিল উত্থাপন করা যায়; লর্ডসভায় অর্থবিল উপস্থাপন করা যায় না।
২. রাজা বা রানীর আনুষ্ঠানিক সুপারিশক্রমে মন্ত্রীগণ কেবল এই বিল উত্থাপন করতে পারেন।
৩. পার্লামেন্টের অনুমোদন ছাড়া কোনো কর ধার্য অথবা সরকারি অর্থ ব্যয় করা যায় না
বিভাগগুলো যাতে অনুমোদিত অর্থ আইনসঙ্গতভাবে ব্যয় করে সেদিকে তিনি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। বিভিন্ন বিভাগের হিসাব পরীক্ষা করে কমনসভার কাছে তিনি রিপোর্ট পেশ করেন। এই রিপোর্টকে বিনিয়োগ হিসাব (Appropriation Accounts) বলা হয়। সরকারের কোনো বিভাগ অর্থের অপচয় করলে তিনি গণিতক কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন।
খ. সরকারি গণিতক কমিটি (The Public Accounts Committee) : সরকারি গণিতক কমিটি আর্থিক ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে। সরকারের বিভিন্ন ব্যয়ের হিসাব এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের রিপোর্ট পর্যালোচনার জন্য কমপসভার নিজস্ব একটি কমিটি আছে। এটি সরকারি গণিতক কমিটি (The Public Accounts Committee) নামে পরিচিত।
গঠন : প্রধানমন্ত্রী গ্লাডস্টোন ১৮৬১ সালে এই কমিটি গঠন করেন। কমন্সসভার বিভিন্ন দলের আসন সংখ্যার অনুপাতে বিভিন্ন দলের ১৫ জন সদস্য নিয়ে এই কমিটি গঠিত হয়। বিরোধী দলের একজন সদস্যকে স্পিকার এই কমিটির সভাপতি পদে নিযুক্ত করেন। অর্থ দপ্তরের সচিব এই কমিটির একজন নিয়মিত সদস্য।
ক্ষমতা ও কার্যাবলি : সরকারি গণিতক কমিটির কার্যাবলি নিম্নরূপ :
ক. যে খাতে যে পরিমাণ অর্থ পার্লামেন্ট বরাদ্দ করেছে তা যথাযথ সেই খাতে ব্যয় করা হয়েছে কিনা কমিটি তা পরীক্ষা করে। খ. উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সরকারি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে কিনা এবং অপব্যয় হয়েছে কিনা কমিটি তাও পরীক্ষা করে। গ. এই কমিটি মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে ।
ঘ. কমিটি সরকারি ব্যয় সম্পর্কে কমন্সসভার কাছে রিপোর্ট পেশ করে।
ঙ. সরকারি আয়–ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ করার পদ্ধতি এবং তার উন্নতির জন্য সুপারিশ করে।
গ. ব্যয় কমিটি (The Expenditure Committee) : আর্থিক বিষয়ে পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করার জন্য ১৯১২ সালে কমন্সসভা আনুমানিক ব্যয় সংক্রান্ত কমিটি (The Estimates Committee) গঠন করে। ১৯৭১ সালের পর এই কমিটির নাম পরিবর্তন করে ব্যয় কমিটি (The Expenditure Committee) রাখা হয়। এই কমিটির মূল কাজ হলো কমন্সসভায় উত্থাপিত সরকারের ব্যয় সংক্রান্ত কাগজপত্র পরীক্ষা করা এবং আনুমানিক ব্যয়ের হিসাব বিচার–বিবেচনা করা। সরকারের ব্যয় বরাদ্দের দাবিকে হ্রাস করেও সরকারি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা তাও এই কমিটি পর্যালোচনা করে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে এই কমিটির পরিবর্তে রাজকোষ ও আমলাতন্ত্র কমিটি (The Treasury and Civil Service Committee) গঠন করা হয়। এই কমিটি কমন্সসভার একটি স্থায়ী কমিটি। এই কমিটি সরকারের দীর্ঘমেয়াদী ব্যয় প্রকল্প পরীক্ষা করে। কমিটি প্রয়োজনবোধে মন্ত্রী, সরকারি কর্মচারীদের প্রভৃতির সাক্ষ্যগ্রহণ করে। বিশেষ পরামর্শ দানের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন এবং প্রয়োজনীয় সরকারি নথিপত্র তার কাছে পেশের জন্য নির্দেশ দিতে পারে। এই কমিটি মিতব্যয়িতা, অপচয়, সাংগঠনিক নৈপুণ্য, পার্লামেন্টে ব্যয় বরাদ্দ পেশের পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয় পর্যালোচনা করে রিপোর্ট পেশ করে। এই কমিটি সারা বছর জুড়ে কাজ করে।
কিন্তু অধ্যাপক ফাইনার প্রমুখ ব্রিটিশ সংবিধান বিশেষজ্ঞ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, সরকার আয়–ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কমন্সসভার বিশেষ কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। তাঁরা তাদের বক্তব্যের সমর্থনে নিম্নলিখিত যুক্তির অবতারণা করেছেন।
ক. কেবিনেটের কর্তৃত্ব : বর্তমানে বাস্তবক্ষেত্রে কেবিনেটই হলো চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। আইন প্রণয়ন, সরকারি আয়– ব্যয় ও অন্য সকল বিষয়ে যাবতীয় ক্ষমতা কেবিনেটের হাতে পুঞ্জিভূত হয়েছে। বর্তমানে দলীয় নিয়ম–শৃঙ্খলার কঠোরতা এবং কমন্সসভা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে কেবিনেট কমন্সসভার সক্রিয় সমর্থন সবসময় পেয়ে থাকে।
খ. অর্থ দপ্তরের নিয়ন্ত্রক : সরকারি আয়–ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রকৃত পক্ষে অর্থ দপ্তর (Treasury) সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। বিভিন্ন বিভাগের ব্যয় হ্রাসের ব্যাপারে অর্থ দপ্তর কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। অর্থমন্ত্রীর ব্যয় বরাদ্দের কোনো প্রস্তাব কমন্সসভা বাতিল করতে পারে না। অর্থ দপ্তর প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে তা কেবিনেটের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের সামিল হয়। কমন্সসভায় সরকারি দলের সমর্থকরা অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবকে নির্দ্বিধায় সমর্থন করেন। অধ্যাপক ফাইনার (Prof. Finer) বলেন, “The Treasury is the first line controller of economy in government. “
গ. কমন্সসভার বৃহৎ আয়তন : কমন্সসভার বৃহৎ আয়তনের ফলে সরকারের আয়–ব্যয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সম্ভব নয়। ৬৫৬ জন সদস্য বিশিষ্ট কমন্সসভার পক্ষে সরকারের অর্থসংক্রান্ত কাজ–কর্মের উপর ধারাবাহিক আলাপ–আলোচনা করা সম্ভব নয়। সমগ্র কক্ষ কমিটি হিসেবে কমথসভার আয়তন বিশাল। তাই এত বড় একটি কক্ষের পক্ষে অর্থ সংক্রান্ত সরকারি প্রস্তাবসমূহের সূক্ষ্ম বিচার–বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়।
৫. ক্যাঙ্গারু ক্লোজার : ক্যাঙ্গারু ক্লোজার (Kangaro Closure) বলতে স্পিকারের কমপসভার আলোচনা বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার একটি পদ্ধতিকে বোঝায়। এটি হলো সভার আলোচনার নিয়ন্ত্রণ বা কাজ করার একটি স্বীকৃত উপায়। কমন্সসভার স্পিকার কোনো একটি প্রস্তাব বা বিল আলোচনার প্রাকালে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাব বা বিলের অংশ বিশেষ বা সেই সংক্রান্ত সংশোধনী প্রস্তাবের অংশ বিশেষ নিজের বিচার-বিবেচনা মতো আলোচনার অনুমতি দিতে পারেন। এভাবে স্পিকার সভার আলোচ্য বিল বা প্রস্তাবের আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত করেন। এই ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্পিকারকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কারণ খেয়াল খুশীমতো এই ক্ষমতা প্রয়োগকে কেন্দ্র করে বিরোধী দল তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলতে পারে। তবে এই ক্ষমতা ব্যবহারের জন্য স্পিকারকে এখনও পর্যন্ত কোনো অভিযোগের সম্মুখীন হতে হয়নি। ১৯০৯ সালে কমন্সসভার স্পিকার সর্বপ্রথম ক্যাঙ্গারু ক্লোজার পদ্ধতি প্রয়োগ করেন।
চ. গিলোটিন : কমন্সসভার আলোচনাকে নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে বেঁধে রাখার জন্য এবং নির্দিষ্ট আলোচ্য সূচি অনুযায়ী সভার আলোচনাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্পিকার অন্যান্য আরও কিছু পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন। এ ধরনের একটি পদ্ধতি হলো গিলোটিন (Guillotine)। এ পদ্ধতি অনুযায়ী কমন্সসভার স্পিকার কোনো প্রস্তাব বা বিষয়ের বিভিন্ন অংশ বা পর্যায়ের আলোচনার সময় নির্ধারণ করেন। প্রতিটি অংশ বা পর্যায়ের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রান্ত হবার পর সংশ্লিষ্ট অংশের উপর আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। এ পদ্ধতিকে আবার খণ্ড খণ্ড ক্লোজার বা ক্লোজার বাই কমপার্টমেন্ট (Closure by compartment) বলা হয় ।
কমন্সসভা নিজ কার্যাবলি পরিচালনা সংক্রান্ত বিধি প্রণয়ন করে। স্থায়ী আদেশের ভিত্তিতে কমন্সসভার কার্যাবলি পরিচালিত হয়। কমন্সসভা প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যপরিচালনা পদ্ধতি পরিবর্তন করতে পারে ।
কমন্সসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি
Powers and Functions of the House of Commons
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের নাম কমন্সসভা। পার্লামেন্টের নির্বাচিত এবং জনপ্রিয় কক্ষ হিসেবে কমন্সসভার হাতে গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। তত্ত্বগতভাবে ব্রিটেনে আইন প্রণয়ন করে রাজা বা রানীসহ পার্লামেন্ট। কিন্তু বাস্তবে ব্রিটেনে পার্লামেন্ট বলতে কমন্সসভাকে বোঝায়। কারণ রাজা বা রানীর ভূমিকা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র এবং লর্ডসভা কমন্সসভার কাজে কিছু বিলম্ব ঘটাতে পারে মাত্র। ব্রিটেনের পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব বলতে কমন্সসভার সার্বভৌমত্বকে বোঝায়। এজন্য ডি লোমী (D Lolme) বলেছেন, “ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নারীকে পুরুষে এবং পুরুষকে নারীতে রূপান্তরিত করা ছাড়া সবকিছুই করতে পারে।” (Parliament can do everything but make a woman man and a man woman), ব্লাকস্টোন বলেছেন, Parliament is not legally subject to any physical limitation. নিম্নে কমন্সসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলিকে কয়েকভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা হলো :
ক. আইন প্রণয়ন : আইন প্রণয়নই হলো কমন্সসভার প্রধান কাজ। কমন্সসভা ব্রিটেন ও তার উপনিবেশগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় যেকোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে। তাছাড়া কমন্সসভা প্রচলিত যে কোনো আইন সংশোধন বা বাতিল করতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ সব বিলই কমন্সসভায় উত্থাপিত হয়। কেবল অ-বিতর্কিত বিলগুলো লর্ডসভায় উত্থাপিত হয়। ১৯১১ সালের পার্লামেন্ট আইন অনুযায়ী অর্থ বিল কমন্সসভার প্রথম পেশ করতে হবে এবং লর্ডসভা তা এক মাসের মধ্যে পাস করবে। তাছাড়া বেসরকারি বিল নিয়ে কমন্সসভা আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কমন্সসভায় যেসব বিল গৃহীত হয় লর্ডসভা সেসব
নিজের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য সচেষ্ট হয়। অপরদিকে সরকারি দল বিরোধী দলের জবাবের মাধ্যমে নিজের জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করে। এর ফলে জনগণ সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে সরকারি দল ও বিরোধী দলের বক্তব্য যথাযথভাবে জানতে পারে। ফলে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে এবং সুষ্ঠু ও সবল জনমত গঠিত হয়।
জ. অভিযোগের প্রতিকার : কমন্সসভা শাসনবিভাগের কার্যকলাপ সম্পর্কে জনগণের অভিযোগের প্রতিকার করে থাকে। ১৯৬৬ সালের পার্লামেন্টারী কমিশনার (Parliamentary Commissioner ) আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কাপসভায় পার্লামেন্টারী কমিশনার পদে সৃষ্টি করা হয়েছে। যে কোনো পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছে শাসনবিভাগের অভিযোগ আনতে পারে। পার্লামেন্টের সংশ্লিষ্ট সদস্য প্রয়োজন মনে করলে সেই অভিযোগ পার্লামেন্টারী কমিশনারের কাছে পেশ করতে পারেন। কমিশনার সংশ্লিষ্ট অভিযোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে অন্যায়মূলক কাজে প্রতিকারের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে আবেদন জানাতে পারেন। সেই দপ্তর এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিলে কমিশনার পার্লামেন্টের কাছে আবেদন জানান। এক্ষেত্রে কমপসভা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
ঝ. জনগণ ও সরকারের মধ্যে সংযোগ সাধন : কমথসভা সদস্যগণ নিজ নিজ এলাকার জনগণের অভাব, অভিযোগ ও সমস্যাবলি সম্পর্কে সভায় আলোচনা করেন। এ সব আলোচনার ভিত্তিতে সরকার প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কমন্সসভা সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ – সাধনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। নির্বাচনি এলাকায় জনসমর্থনের স্বার্থে প্রধান দুটি দলের সদস্যগণ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন। স্যামুয়েল বীয়ার ( S. Bear ) কমন্সসভার সংযোগ সাধনের কাজের উপর বিশেষ গুরত্ব আরোপ করেছেন।
ঞ. তদন্তমূলক কাজ : কমপসভা কিছু তদন্তমূলক দায়িত্ব পালন করে। বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে কমন্সসভা এই তদস্তমূলক ক্ষমতা প্রয়োগ করে। কমন্সসভার দাবি অনুযায়ী কোনো মন্ত্রী জনমতের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে তদন্তে র ব্যবস্থা করতে পারেন। এই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বিভাগীয় কমিটি, সিলেক্ট কমিট বা রাজকীয় কমিশন গঠন করতে পারেন। এই কমিটি তথ্যসংগ্রহ, সাক্ষ্যগ্রহণ, অনুসন্ধান প্রভৃতির মাধ্যমে বিচার্য বিষয়ে রিপোর্ট পেশ করে। উদাহরণস্বরূপ সামরিক বাহিনীর পুনর্বিন্যাস, শিক্ষা, সরকারি প্রশাসন, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে তদন্ত রিপোর্টের কথা বলা যায় ।
ট. সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা : কমন্সসভা সংবিধান সংশোধনে ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে লর্ডসভা এবং কমন্সসভার ক্ষমতা সমান। যে পদ্ধতিতে সাধারণ আইন প্রণীত, সংশোধিত হয় সেই একই পদ্ধতিতে কমন্সসভা সংবিধান সংশোধন করতে পারে। কমন্সসভায় উপস্থিত এবং ভোটদানকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনে যেভাবে সাধারণ বিল অনুমোদিত হয়, সেই একইভাবে সংবিধান পরিবর্তন বা সংশোধন করা যায়।
ঠ. শিক্ষামূলক ভূমিকা : কমন্সসভা শিক্ষামূলক বহু কার্যাবলি সম্পন্ন করে। এ সভায় অনুষ্ঠিত বিতর্ক জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ওয়াল্টার বেজহট (Walter Begehot) কমন্সসভাকে একটি শিক্ষা কক্ষ (Teaching Chamber) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এটি কেবিনেট সদস্যদের রাজনৈতিক শিক্ষা কেন্দ্র। কার্টার, রেনী এবং হার্জ (Carter. Ranney and Herz) এর মতে, কমন্সসভার বিতর্কের আপেক্ষিক সারল্য ও সুস্পষ্টতার জন্য রাজনৈতিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পার্লামেন্টের ভূমিকা কার্যকর হয়েছে। কমন্সসভার দিকেই সকলের উৎসাহ কেন্দ্রীভূত হয়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিতর্কের গভীরতা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ড. বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা : কমন্সসভা বিচার সংক্রান্ত কিছু ক্ষমতা ভোগ করে। কোনো ব্যক্তি কমন্সসভার অসম্মান করলে তাকে স্পিকারের স্বাক্ষরযুক্ত ওয়ারেন্টের মাধ্যমে গ্রেফতার করে কমন্সসভার এজলাশে হাজির করা যায়। কমন্সসভা তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারে বা মুক্ত করে দিতে পারে। কোনো আদালত পার্লামেন্টের বিচারের উপর কোনো প্রশ্ন তুলতে বা রায় দিতে পারে না।
ঢ. ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের সৃষ্টি : কমপসভা রাষ্ট্রপারচালনার জন্য ভবিষ্যতের যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করে। কমন্সসভার আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সভার তরুণ ও উদ্যমী সদস্যগণ রাষ্ট্র পরিচালনার শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রের নেতৃত্ব গ্রহণে সহায়তা করে। কমন্সসভার বিতর্কে যাঁরা যোগ্যতার পরিচয় দেন তাদের দল সরকার গঠন করলে তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন।
বিল বাতিল করতে পারে না। ১৯৪৯ সালের পার্লামেন্ট আইন অনুযায়ী কমন্সসভার পরপর দুটি অধিবেশনে যদি কোনো বিল গৃহীত হয় এবং প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় পাঠ এবং দ্বিতীয় পাঠের মধ্যে যদি এক বছর সময় অতিক্রম হয় তবে লর্ডসভায় অনুমোদন ছাড়াই উক্ত বিল রাজা বা রানীর সম্মতির জন্য প্রেরিত হয়।
অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা : ১৯১১ সালের পার্লামেন্ট আইন অনুযায়ী অর্থসংক্রান্ত বিষয়ে লর্ডসভার কোনো কার্যকরী ক্ষমতা নেই বললেই চলে। সকল অর্থবিল এবং বাজেট কেবল কমগসভায় উত্থাপিত হয়। কমথসভা কর্তৃক গৃহীত কোনো অর্থবিলতে লর্ডসভা প্রত্যাখান করতে কিংবা সংশোধন করতে পারে না। কোনো অর্থবিল ১ মাসের মধ্যে লর্ডসভা কর্তৃক অনুমোদিত না হলে লর্ডসভার অনুমোদন ছাড়াই সংশ্লিষ্ট বিলটিকে রাজা বা রানীর সম্মতির জন্য প্রেরণ করা হয়। তাছাড়া কোনো বিল অর্থ বিল কিনা তা নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে সে ব্যাপারে কমথসভার স্পিকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কমলসভার অনুমোদন ছাড়া সরকার কর ধার্য, কর সংগ্রহ এবং অর্থব্যয় করতে পারে না। ব্রিটেনের সঞ্চিত তহবিল থেকে অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন দেখা দিলে সরকারকে কমনসভার অনুমতি নিতে হয়। কমন্সসভার ভোটাভুটির মাধ্যমে বাজেট পাস হয়। সরকারি গণিতক কমিটি Accounts Committee), মহাহিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (Comptroller and Auditor General) আনুমানিক ব্যয় হিসাব কমিটি (Estimate Committee) প্রভৃতির মাধ্যমে কমণসভা সরকারি আয়-ব্যয় ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
গ, সরকার গঠন : সাধারণ নির্বাচনের পর যে দল অসসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলই সরকার গঠন করে। প্রথাগত বিধান অনুযায়ী কমন্সসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকেই রাজা বা রানী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। তারপর প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে তিনি অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ করেন। তবে পার্লামেন্টের কোনো কক্ষের সদস্য না হয়েও মন্ত্রী হওয়া যায়। এক্ষেত্রে তাকে ৬ মাসের মধ্যে কমন্সসভার সদস্য হতে হয়। বর্তমানে প্রথাগত বিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীকে কমন্সসভার সদস্য হতে হয় ।
ঘ. সরকারকে নিয়ন্ত্রণ : ব্রিটেনে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক নীতি হলো কমন্সসড়ার কাছে মন্ত্রিসভার দায়িত্বশীলতা। মন্ত্রিগণ তাদের সম্পাদিত কার্যাবলির জন্য ব্যক্তিগতভাবে এবং যৌথভাবে কমন্সসভার কাছে দায়ী থাকেন। কমলসভা যতদিন মন্ত্রিসভার উপর আস্থা রাখে ততদিন মন্ত্রিসভা ক্ষমতাসীন থাকে। সরকারের অস্তিত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল। স্যার আইভর জেনিংস (Sir Ivor Jennings) বলেছেন ‘The government exists because it has a majority in the House. তাই কমন্সসভার আস্থা হারালে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। তাছাড়া কমন্সসভা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, মূলতবি প্রস্তাব, নিন্দাসূচক প্রস্তাব, দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব, অনাস্থা প্রস্তাব ইত্যাদি উত্থাপনের মাধ্যমে মন্ত্রিসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
ঙ. বিতর্ক ও আলোচনা : কমন্সসভার অন্যতম কাজ হলো বিতর্ক ও আলোচনা। সাধারণত দেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত সকল বিষয়ে কমন্সসভার বিতর্ক এবং আলাপ-আলোচনা হয়ে থাকে। সরকারি বিল, বেসরকারি বিল, কমন্সসভার প্রেরিত বাণী, পার্লামেন্টে প্রদত্ত রানীর ভাষণ ইত্যাদির উপর কমন্সসভার বিতর্ক ও আলোচনা চলে। বিরোধী দল সরকারের নীতি ও কর্মের সমালোচনার মাধ্যমে কমন্সসভা উত্তপ্ত রাখে। কমন্সসভার সদস্যগণ প্রশ্ন জিজ্ঞাসার মাধ্যমে মন্ত্রীদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন। মূলতবি প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে কোনো সদস্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার দাবি করতে পারেন। কমন্সসভার বিতর্ক ও আলোচনা বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র প্রভৃতি গণসংযোগের মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়। অধ্যাপক লাস্কি (Laski) বলেছেন, “A Government that is compelled to explain itself under cross examination will do its best to avoid the grounds of complaint. Nothing makes responsible government so sure.”
চ. সংবাদ ও তথ্য সরবরাহ : কমপসভা সংবাদ ও তথ্য সরবরাহকারী সংস্থা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কমন্সসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারের কার্যাবলি সম্পর্কে সদস্যগণ মন্ত্রীদের বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। এসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তরের উপর সরকারের সুনাম-দুর্নাম নির্ভর করে। মন্ত্রীদের এসব প্রশ্নের উত্তর নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে । জনগণ এসব তথ্য বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র প্রভৃতির মাধ্যম জানতে পারে। এর ফলে জনগণ সরকারের নীতি ও কার্যকলাপ সম্পর্কে সঠিক সংবাদ ও তথ্য জানার সুযোগ লাভ করে।
ছ. জনমত গঠন : কমন্সসভা জনমত গঠনের প্রধান বাহন হিসেবে কাজ করে। এটি সরকারি নীতি ও কাজ-কর্মের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে। বিরোধী দল সরকারের জনস্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত ও কাজকর্মের তীব্র সমালোচনা করে। এভাবে বিরোধী দল
or place out of parliament.” অর্থাৎ “পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে সদস্যদের কথা বলার, বিতর্ক করার বা কার্যনির্বাহে অংশগ্রহণ করার স্বাধীনতা রয়েছে। এ সম্পর্কে পার্লামেন্টের অনুমতি ছাড়া অন্যকোনো আদালতে বা স্থানে অভিযোগ উত্থাপন বা প্রশ্ন তোলা যাবে না।”
খ. গ্রেপ্তার না হওয়ার স্বাধীনতা (Freedom of not of be Arrested) : কমথসভার অধিবেশন চলাকালীন দেওয়ানী মামলার অভিযোগে কোনো সদস্যকে গ্রেপ্তার বা আটক করা যায় না। পার্লামেন্টের অধিবেশন চলাকালীন ছাড়াও অধিবেশন শুরু হওয়ার ৪০ দিন আগে ও শেষ হবার ৪০ দিন পরে কমথসভার সদস্যগণ এই স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন। তবে ফৌজদারি অভিযোগে কিংবা নিরাপত্তা আটক আইনে কমপসভার যেকোনো সদস্যকে কক্ষের বাইরে মোস্তার করা যায়। কাউকে কারারুদ্ধ বা আটক করা হলে সেই সম্পর্কে অবিলম্বে অবহিত হবার অধিকার পার্লামেন্টের আছে। পূর্বে দেওয়ানী মামলা পরিচালনা করবার জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেন্তার করা হতো। কিন্তু বর্তমানে বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া দেওয়ানী মামলা দায়েরের জন্য কাউকে আটক করার ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয়েছে।
গ. জুরি বা সাক্ষী হিসেবে আদালতে হাজির না হওয়ার স্বাধীনতা (Freedom from A tttention of jurious and witness) : জুরি হিসেবে কোনো মামলায় অংশগ্রহণের জন্য বা কোনো মামালায় সাক্ষ্যদানের জন্য আদালত আহ্বান করলে যে কোনো সাধারণ নাগরিক সেই অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য। কিন্তু উক্ত দুটি ক্ষেত্রে কমলসভার সদস্যগণ অব্যাহতি ভোগ করেন। কোনো মামলার বিচারের সময় জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে কমথসভার সদস্যদের বাধ্য করা যায় না। আবার কমন্সসভার অধিবেশন চলাকালে কোনো সদস্যকে সভার অনুমতি ছাড়া কোনো মামলার আদালতে সাক্ষী হিসেবে হাজির হতে
বাধ্য করা যাবে না।
ঘ. অভ্যন্তরীণ কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণের অধিকার (Right to control the internal proceedings of the House ) : সভার কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ নিজ নিজ গঠন, কার্যক্রম, কার্যপদ্ধতি ইত্যাদি স্বাধীনভাবে নির্ধারণ করতে পারে। আদালত এই কার্যপদ্ধতির উপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। কমন্সসভা তার কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন মতো বিধি-নিয়ম প্রণয়ন করতে পারে এবং সেগুলোকে প্রয়োগ করতে পারে। আবার কমন্সসভা তার সদস্যদের আইনগত অযোগ্যতার মান নির্ধারণ করতে পারে। অভ্যন্তরীণ কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আদালত যে কিছু করতে পারে না সে ব্যাপারে একটি ঘটনার উল্লেখ করা হলো। ১৮৮৪ সালে ব্র্যাডলাফ (Bradlaugh) নামে একজন নাস্তিক (Atheist ) নরদামপটন (Northampton) নামক কেন্দ্র থেকে কমন্সসভার সদস্য নির্বাচিত হন, শপথ গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি এই অভিযোগে তিনি সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস (Sergent at arms) এর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু এটি কমন্সসভার অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে আদালত বিচার করতে অস্বীকৃতি জানায় ।
৫. অবমাননার জন্য দত্ত বিধানের অধিকার (Right to committant for contempt) : অধিকার ভঙ্গ ও সভার অবমাননার দায়ে যে কোনো ব্যক্তিকে কমন্সসভা কারাগারে প্রেরণ করতে পারে। পার্লামেন্টের সদস্য নন এমন কোনো ব্যক্তি পার্লামেন্টের কোনো সদস্যকে ভীতি প্রদর্শন করলে কিংবা সভার আদেশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করলে তা কমন্সসভার অবমাননা বলে গণ্য হবে। হারভে এবং ব্যাথার (Hurvey and Bather) বলেছেন, “Contempt can occur when a non- member threatens or intimidates a member of parliaments or when any body is disobedient to or intervents with the execution of order of the House. ” অবমাননাকারীকে কমথসভা তিন ধরনের শাস্তি দিতে পারে। (১) কমন্সসভা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সভায় হাজির হতে বলতে পারে এবং সভার অবমাননার জন্য অভিযুক্তকে সতর্ক করতে পারে। (২) অভিযুক্তকে জোর করে সভায় হাজির করে তীব্রভাবে তিরস্কার করতে পারে, (৩) অভিযোগ গুরুতর হলে সভা অভিযুক্তকে গ্রেন্ডার করতে এবং কারাগারে প্রেরণে করতে পারে।
চ. সাধারণ নাগরিকদের কক্ষে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার অধিকার (Right to exclude strangers) : কমন্সসভা সাধারণ নাগরিকদের সভ্য কক্ষে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। সভার আলোচনার ও বিতর্কের গোপনীয়তা রক্ষা করার দরকার হলে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সাধারণত যুদ্ধ, জরুরি অবস্থা বা আপৎকালীন এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। তাছাড়া কমন্সসভার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
ছ. কার্যবিবরণী প্রকাশের স্বাধীনতা (Right to publish debates and proceedings) : পূর্বে প্রচলিত প্রথাগত আইন অনুযায়ী কমলসতা তার নিজের সদস্য ছাড়া অন্য কারও কাছে তার কার্যবিবরণী সংক্রান্ত কাগজপত্র প্রকাশ করতে পারত না। কিন্তু ১৮৪০ সালে পার্লামেন্টের কাগজপত্র সংক্রান্ত আইন (The Parliamentary Papers Act, 1840) প্রণীত হওয়ার পর এই বাধা অপসারিত হয়েছে। বর্তমানে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষই তাদের আলোচনা ও বিতর্ক সংক্রান্ত কাগজপত্র প্রকাশ করতে পারে। এ বিষয়ে আদালতে মানহানির কোনো মামলা দায়ের করার সুযোগ নেই।
পরিশেষে বলা যায় কমথসভার কাজ-কর্ম ও আচরণের ত্রুটি-বিচ্যুতি দীর্ঘকাল যাবৎ সমালোচিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালে সংসদীয় বিশেষাধিকারের উপর একটি সিলেক্ট কমিটি গঠিত হয়। ১৯৬৭ সালে সিলেক্ট কমিটি রিপোর্ট দেয় যে, সংসদীয় বিশেষাধিকার কথাটি ব্যবহার করার চেয়ে অধিকার বিমুক্তি ও অবমাননা এই কথাগুলো ব্যবহার করা অনেক ভালো। বিশেষাধিকার কথাটির দ্বারা বোঝায় যে পার্লামেন্টের সদস্যগণ একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি। কমিটি আরও সুপারিশ করে যে, পার্লামেন্ট ইচ্ছেমতো বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করবে না। নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন হলে কমণসভা এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে।