শাসন বিভাগ

The Executive

একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য Characteristics of Dictatorship

একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য 

Characteristics of Dictatorship 

শাসন বিভাগ হলো সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী বিভাগ। সকল দেশের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন শাসন বিভাগকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় বিধায় সরকারের অপরাপর বিভাগের মধ্যে সঙ্গত কারণে শাসন বিভাগ রাষ্ট্র পরিচালনায় সরাসরি অংশ নিয়ে থাকে। রাষ্ট্রের ইচ্ছা, অনিচ্ছা শাসন বিভাগের মাধ্যমে কার্যকরী হয়। যে কারণে শাসন বিভাগের উৎকর্ষের উপর একটি সরকারের সুনাম, স্থায়িত্ব এবং সমৃদ্ধি নির্ভর করে। যদিও রাষ্ট্রের সংবিধান শাসন বিভাগের এখতিয়ার নির্ধারণ করে থাকে, তথাপি বর্তমান সমস্যাসঙ্কুল পৃথিবীতে শাসন বিভাগের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে চলছে।

শাসন বিভাগ The Executive

শাসন বিভাগ হলো সরকারের সেই শাখা যা আইন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত আইন প্রয়োগ করে শাসনকার্য নির্বাহ করে। শাসন বিভাগকে ব্যাপক ও সংকীর্ণ-এই দুটি অর্থে ব্যবহার করা যায়। এ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো :

ব্যাপক অর্থে শাসন বিভাগ : ব্যাপক অর্থে শাসন বিভাগ বলতে আইনের মাধ্যমে প্রকাশিত রাষ্ট্রের ইচ্ছাকে কার্যকরী করতে নিয়োজিত কর্মচারী ও শাখাগুলোর সমষ্টিকে বুঝায়। অর্থাৎ, আইন প্রণয়ন ও বিচারকার্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত এমন সকল কর্মচারীর সমষ্টিকেই শাসন বিভাগ বলা যায়। এদিক থেকে রাষ্ট্রের শাসনকার্যে নিয়োজিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে গ্রাম্য চৌকিদার পর্যন্ত সকল কর্মকর্তাই শাসন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত।

সংকীর্ণ অর্থে শাসন বিভাগ : সংকীর্ণ অর্থে শাসন বিভাগ বলতে মন্ত্রিসভাসহ সরকার প্রধানকে বুঝায়। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় উপাধি সর্বস্ব রাষ্ট্রপ্রধান ও তাঁর মন্ত্রিমণ্ডলীকে নিয়েই শাসন বিভাগ গঠিত হয়। আর রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি ও তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়েই শাসন বিভাগ গঠিত হয়।

১. রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডুভার্জার (Duverger)-এর মতে, “আইনসভা ও বিচার বিভাগ ব্যতীত সরকারি কাজে নিয়োজিত সব কর্মকর্তাই শাসন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত।”

২. প্রফেসর ফাইনার (Finer)-এর মতে, “শাসন সংক্রান্ত কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তির সমন্বয়ে শাসন বিভাগ গঠিত।” ৩. অধ্যাপক গার্নার ( Prof. Garner ) -এর মতে, “শাসনকার্যের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিকে নিয়ে শাসন বিভাগ গঠিত হয়।

এ অর্থে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সচিবগণ এবং তাদের অধীনস্থ কর্মচারীবৃন্দ, বেসামরিক ও সামরিক আমলাগণ এবং তাদের অধীনস্থ কর্মচারীদের সমন্বয়ে শাসন বিভাগ গঠিত ।”

৪. অধ্যাপক ম্যাকাইভার (Maclver)-এর মতে, “শাসন বিভাগ হলো শাসনব্যবস্থার নীতি ও কার্যক্রম নির্ধারণে নিয়োজিত

শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ।”

৫. কোরি (Corry) বলেন, “The essence of government is executive, the legislature and judiciary are

merely the instruments for constitutionalising it.”

সুতরাং বলা যায় যে, শাসন বিভাগ হলো সরকারের সেই বিভাগ যা আইন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত আইন বলবৎ করে এবং সরকারি নীতি প্রয়োগ করে।

শাসন বিভাগের গঠন প্রণালি Organization of the Executive

সাধারণ নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। তার মধ্যে কতিপয় ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয় শাসন বিভাগ। মন্ত্রিসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলেই শাসন বিভাগের অন্তর্গত। এক্ষেত্রে শাসন বিভাগের দুটি অংশ রয়েছে। যথা : রাজনৈতিক অংশ (Political portion) এবং অরাজনৈতিক অংশ (Non-political portion)। রাজনৈতিক অংশ গঠিত হয় জনগণের বা পার্লামেন্টের নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়ে। অর্থাৎ, শাসন বিভাগের যে অংশ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয় তাকে রাজনৈতিক অংশ বলা হয়। যেমন- রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যগণের সমন্বয়ে রাজনৈতিক অংশ গঠিত। অপরদিকে অরাজনৈতিক অংশ হলো শাসন বিভাগের স্থায়ী কর্মচারীবৃন্দ। যথা- প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগকৃত স্থায়ী কর্মচারী। অর্থাৎ, যারা গুণগত যোগ্যতার ভিত্তিতে শাসনকার্যে যোগ দেয় তাদেরকে অরাজনৈতিক অংশ বলে। এর প্রকৃত উদাহরণ হলো আমলাগণ ।

শাসন বিভাগের প্রকারভেদ Classification of the Executive

বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ এক রকম নয়। প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে এক এক দেশের শাসন বিভাগ এক এক রকম হয়ে থাকে। আবার রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের শাসন বিভাগ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। নিম্নে বিভিন্ন প্রকৃতির শাসন বিভাগ আলোচনা করা হলো :

১. নামসর্বস্ব প্রকৃত শাসন বিভাগ (Nominal and real executive) : রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা যখন একজন নামমাত্র শাসক প্রধানের হাতে ন্যস্ত থাকে তখন তাকে নামসর্বস্ব শাসন বিভাগ বলে। এ ব্যবস্থায় প্রকৃত নির্বাহী ক্ষমতা থাকে অপর একজনের হাতে। নামসর্বস্ব শাসক প্রধানের নামে রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালিত হলেও তিনি কেবলমাত্র কয়েকটি আনুষ্ঠানিক কাজের দায়িত্ব পান। যেমন : যুক্তরাজ্যের রাজা বা এবং ভারত ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।

অপরদিকে প্রকৃত নির্বাহী শাসন ক্ষমতার অধিকারী যখন রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান নিজেই হন, তখন তাকে প্রকৃত শাসন বলে। অর্থাৎ, শাসন বিভাগের তিনি ক্ষমতার অধিকারী ও নিজেই ক্ষমতা প্রয়োগ বা শাসন করেন। যেমন : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাজ্য, ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও তাদের মন্ত্রিপরিষদ।

২. একক সমষ্টিগত শাসন বিভাগ (Single and plural executive) : রাষ্ট্রের শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা যখন একজন ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রিভূত থাকে ও তিনি শাসনকার্য পরিচালনা করেন, তখন তাকে একক শাসন বিভাগ বলে। একনায়কতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রপতি শাসন পদ্ধতিতে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। হিটলার ও মুসোলিনীর শাসন বিভাগ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পক্ষান্তরে যে শাসন বিভাগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কয়েকজনের হাতে ন্যস্ত থাকে, তাকে সমষ্টিগত শাসন বিভাগ বলে। এতে একাধিক ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টি শাসনকার্য পরিচালনা করে এবং সকলেই সমমর্যাদা ভোগ করে। এর নেতা প্রধানমন্ত্রী বা নির্বাহী প্রধান। যেমন- সুইজারল্যান্ডের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ। তবে অধিকাংশ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় বর্তমানে এ পদ্ধতি প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের শাসন বিভাগের কথা বলা যায় ।

 সংসদীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন বিভাগ (Parliamentary and presidential executive ) : সংসদীয় শাসন বিভাগ হচ্ছে এমন এক শাসন, যার নির্বাহী বিভাগ আইন বিভাগের নিকট দায়বদ্ধ। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের নিয়ে গঠিত, মঞ্জিসভার হাতে দেশের শাসন সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত থাকে, যার প্রধান হলো একজন প্রধানমন্ত্রী। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের শাসন পদ্ধতির কথা বলা যায়। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় রাজা বা রাষ্ট্রপতি নামেমাত্র বা প্রতীকী অর্থে শাসক প্রধান থাকেন।

অপরদিকে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন বিভাগের সমস্ত ‘ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পরিচালিত হয়। যে কারণে শাসন বিভাগ আইন বিভাগের নিকট দায়ী থাকে না। এ ব্যবস্থায় জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষ ভোটে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির কথা বলা যেতে পারে।

৪. উত্তরাধিকার সূত্রে মনোনীত নির্বাচিত শাসন বিভাগ (IHereditary and elected executive) : যে শাসন বিভাগীয় প্রধানের ক্ষমতা উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তরিত হয়, তাকে উত্তরাধিকার শাসন বিভাগ বলে। সনাতনধর্মী এ শাসন বিভাগে রাজা বা রানী সীমিত ক্ষমতা লাভ করেন। এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের শাসন বিভাগের কথা বলা যায় ।

অপরদিকে, জনগণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত সরকারের শাসন বিভাগ হলো নির্বাচিত শাসন বিভাগ। এতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে শাসকবর্গ নির্বাচিত হয়। আর পরোক্ষ নির্বাচনে শাসকবর্গ কোনো সংস্থার মাধ্যমে নির্বাচিত হয় । এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা বলা যায়, যেখানে প্রেসিডেন্ট সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত না হয়ে একটি ইলেকটোরাল কলেজ বা নির্বাচনি সংস্থা কর্তৃক নির্বাচিত হয়।

৫. নিয়মতান্ত্রিক, রাজতান্ত্রিক ধর্মতান্ত্রিক শাসন বিভাগ : যে শাসন বিভাগে সংসদীয় সরকারের পাশাপাশি সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন শাসক রাখা হয়, তাকে নিয়মতান্ত্রিক শাসন বিভাগ বলা হয়। যেমন : ভারত ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কথা বলা যায়।

রাজতান্ত্রিক শাসন বিভাগে রাজতন্ত্রের অধীনে রাজা বা রানী সীমিত ক্ষমতা ভোগ করলেও প্রকৃত ক্ষমতার মালিক প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভা। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের রানীর কথা বলা যায়’। তবে অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন রাজা বা রানীর শাসন প্রাচীন বা মধ্যযুগেও প্রচলিত ছিল।

মধ্যযুগে এরূপ শাসক ছিল যারা ইহকালীন ও পরকালীন জীবন নিয়ন্ত্রণ করত তাদেরকে বলা হয় ধর্মতান্ত্রিক শাসক । যেমন, বর্তমানেও ইরান, ভ্যাটিকান সিটি প্রভৃতি রাষ্ট্রে ধর্মতান্ত্রিক শাসন বিদ্যমান। কিন্তু বর্তমানে অপরাপর রাষ্ট্রে এ ধরনের শাসনের প্রভাব খুব একটা নেই ।

৬. সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র সামরিকতন্ত্রের শাসন বিভাগ : সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কমিউনিস্ট পার্টির একদলীয় ও সর্বাত্মক শাসন প্রচলিত । একনায়কতন্ত্রে একদলীয় শাসন বা একক শাসন বিভাগ থাকে। তাকে কারো নিকট জবাবদিহি করতে হয় না। আর সামরিকতন্ত্রে এক ব্যক্তিই সর্বেসর্বা। তাঁর আদেশই আইন। তিনিই দণ্ডমুণ্ডের হর্তাকর্তা। তিনি একাধারে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান ও সামরিক আইন প্রশাসক ।

Leave a Reply