Table of Contents
Toggleএকদলীয় ব্যবস্থা বলতে কী বুঝ? একদলীয় ব্যবস্থার সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ আলোচনা কর ।
একদলীয় ব্যবস্থা Single Party System
যখন সমগ্র দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত থাকে তখন তাকে একদলীয় ব্যবস্থা বলা হয়। একটিমাত্র দলই তার আদর্শ, নীতি ও কর্মসূচি অনুযায়ী সরকার এবং রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনা করে। রডি এবং অন্যান্য গবেষক এক দলীয় ব্যবস্থাকে এমন একটি ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণনা করেছেন যেখানে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ইচ্ছা নেতা এবং মুষ্টিমেয় রাজনৈতিক ক্ষমতাধারীর হাতে ন্যস্ত থাকে। একদলীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দল ব্যতীত অন্য সকল দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে দলীয় শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। অধ্যাপক অ্যালমন্ড (Almond) একদলীয় ব্যবস্থাকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা— i. সাধারণ একদলীয় ব্যবস্থা, ii. সর্বাত্মক একদলীয় ব্যবস্থা এবং iii. সাম্যবাদী একদলীয় ব্যবস্থা ।
ক. সাধারণ একদলীয় ব্যবস্থা : সাধারণ একদলীয় ব্যবস্থায় একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের সর্বময় কর্তৃত্ব স্বীকৃত। এখানে অন্য দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত হয় না। নির্বাচনের সময় একটিমাত্র দলের প্রার্থীরাই পরস্পরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সাধারণ একদলীয় ব্যবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো— মিসর, স্পেন, তানজানিয়া, কেনিয়া প্রভৃতি দেশ ।
খ. সর্বাত্মক একদলীয় ব্যবস্থা : সর্বাত্মক একদলীয় ব্যবস্থায়ও একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত। তবে এই একমাত্র দলটির নীতি ও মতাদর্শ চরম, অভ্রান্ত এবং শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করা হয়। দলটি দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ঐ একটিমাত্র দলই তার আদর্শ ও নীতি অনুযায়ী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণ করে। শাসক দলই রাজনৈতিক নিয়োগের দায়িত্ব পালন করে। অন্য কোনো দলের অধিকারের স্বীকৃতি এখানে নেই। এখানে বিরোধী মতামত ও বিরোধী দলকে কঠোর হস্তে দমন করা হয়। এ ধরনের একদলীয় ব্যবস্থায় সদস্যদের সার্বিক আনুগত্য সুনিশ্চিত করার জন্য দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। মারাত্মক একদলীয় ব্যবস্থার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো : হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানির নাৎসি পার্টি, মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালির ফ্যাসিস্ট পার্টি।
গ. সাম্যবাদী একদলীয় ব্যবস্থা : সাম্যবাদী একদলীয় ব্যবস্থাও সর্বাত্মক। তবে সাম্যবাদী সর্বাত্মক একদলীয় ব্যবস্থাকে এগণতান্ত্রিক বলা যায় না। সমাজতান্ত্রিক সমাজ হলো শ্রেণিহীন ও শোষণহীন। তাই এখানে একাধিক রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন নেই। সাম্যবাদী একদলীয় ব্যবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টি নামে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকে। এই দল গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার (Democratic centralization) নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। উদাহরণস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের একদলীয় ব্যবস্থার কথা বলা যায়। ফ্যাসিবাদী বা নাৎসিবাদী সর্বাত্মক একদলীয় ব্যবস্থায় ব্যক্তিপূজা স্বীকৃত এবং এখানে ধনতান্ত্রিক শাসন ও শোষণ চলতে থাকে। কিন্তু সাম্যবাদী সর্বাত্মক একদলীয় ব্যবস্থায় ব্যক্তিপূজা অস্বীকৃত এবং এটি ধনতান্ত্রিক সমাজের অবসান ঘটিয়ে শ্রেণিহীন ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। একদলীয় ব্যবস্থার গুণাবলি Merits of Single Party System
একদলীয় ব্যবস্থার গুণাবলি নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. জাতীয় ঐক্য ও সংহতি : এক দলীয় ব্যবস্থায় সমগ্র দেশে একটিমাত্র রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত হয়। দেশের জনগণ একটি মাত্র রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় এবং সমমতাদর্শের ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ হয়। ফলে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় থাকে।
২. দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ : একদলীয় ব্যবস্থা কোনো জাতীয় সমস্যা বা সংকটকালে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযোগী। দ্বি-দলীয় এবং বহুদলীয় ব্যবস্থায় অর্থহীন বিতর্ক ও বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে অযথা সময়ের অপচয় হয়। কিন্তু একদলীয় ব্যবস্থা এ ধরনের ত্রুটি থেকে মুক্ত বলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়।
৩. সরকারের স্থায়িত্ব : একদলীয় ব্যবস্থায় জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে একটিমাত্র দলের আধিপত্য ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয় ৷ ফলে সরকার বিশেষভাবে স্থায়ী হয়। স্থায়িত্বের ব্যাপারে নিশ্চয়তা থাকে বলে সরকার জনকল্যাণ সাধনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে ।
৪. অপব্যয় হয় না : একদলীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যয় হয় না। একদলীয় ব্যবস্থার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্যগণ নির্বাচিত হতে পারেন। নির্বাচনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয় না। ফলে একদলীয় ব্যবস্থা অর্থনৈতিক দিক থেকে সাশ্রয়ী। উদ্বৃত্ত অর্থ উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করা যায়।
৫. জরুরি অবস্থায় উপযোগী : একদলীয় ব্যবস্থা জরুরি অবস্থার জন্য উপযোগী। এতে বহুদলীয় ব্যবস্থার মতো বিতর্ক, বিরোধিতা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সময়ের অপচয় হয় না। একদলীয় ব্যবস্থায় দ্রুত নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় বলে তা জরুরি অবস্থায় বেশি কার্যকর।
৬. দ্রুত উন্নতি : একদলীয় ব্যবস্থা দ্রুত উন্নতি ও প্রগতির সহায়ক কারণ এতে দলীয় নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয় না। দেশে স্বীকৃত একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকায় উক্ত দলটি জনকল্যাণের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনস্বার্থ সাধনে আত্মনিয়োগ করে, ফলে দেশের সামগ্রিক উন্নতি ও অগ্রগতি সাধিত হয়। উদাহরণ হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কথা বলা যায় ।
৭. দলীয় শৃঙ্খলা : একদলীয় ব্যবস্থায় কঠোর দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখা সহজ। বহুদলীয় ব্যবস্থার মতো একদলীয় ব্যবস্থায় দলাদলি, রেষারেষি এবং পারস্পরিক বিরোধিতা থাকে না। এর ফলে দলীয় আনুগত্য সুদৃঢ় থাকে এবং দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না। এতে পারস্পরিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই।
৮. গণতন্ত্র বিরোধী নয় : একদলীয় ব্যবস্থা গণতন্ত্র বিরোধী এ ধারণা সঠিক নয়। দেশের সমস্যাবলির বিশ্লেষণ, সরকারি কার্যকলাপের গঠনমূলক সমালোচনা, পারস্পরিক মতবিনিময়ের সুযোগ প্রভৃতি গণতান্ত্রিক উপাদান একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় বর্তমান ।
৯. শিল্প-সাহিত্যের উন্নতি : একদলীয় ব্যবস্থায় শিল্প, সাহিত্য এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়। এ সময় শিল্প, সাহিত্য এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা বৃদ্ধি পায়। ইতিহাসের যা কিছু মহান সৃষ্টি তার বেশির ভাগই সম্ভব হয়েছে কোনো না কোনো রাজার বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতায় ।
১০. দক্ষ শাসন : একদলীয় ব্যবস্থা প্রকৃতিগভাবে সহজ সরল প্রকৃতির। বহুদলীয় ব্যবস্থার মতো এতে সরকার বদলের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠান, প্রচারণা, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা প্রভৃতি জটিলতা নেই। ফলে একদলের আওতায় দক্ষ শাসন গড়ে তোলা সম্ভব ।
একদলীয় ব্যবস্থার দোষাবলি Demerits of Single Party System
একদলীয় ব্যবস্থার বেশ কিছু দোষ-ত্রুটি আছে বলে গণতন্ত্রের প্রবক্তাগণ মনে করেন। একদলীয় ব্যবস্থার দোষাবলি নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. গণতন্ত্র বিরোধী শাসন : একদলীয় ব্যবস্থা গণতন্ত্র বিরোধী, এতে জনগণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। একদলীয় শাসনে মিথ্যা প্রচারণার ফলে জনগণের চিন্তা ও মানসিকতার স্বাধীন বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের রাজনৈতিক অধিকার ও চেতনা নিয়ন্ত্রিত হয়।
২. ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী : একদলীয় ব্যবস্থা ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধী। এতে ব্যক্তির চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সরকারের সমালোচনা করার স্বাধীনতা ইত্যাদি থাকে না। চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া স্বাধীনতা থাকতে পারে না। অধ্যাপক দেবেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী (D. N. Benerjee) বলেছেন, “Liberty of thought and discussion which is so fundamental to democracy cannot exist in a one-party-state.”
৩. স্বৈরাচারী শাসন : একদলীয় শাসনব্যবস্থায় স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ এতে বিরোধী কোনো দল বা মতের অস্তিত্ব থাকে না। প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো দলের অস্তিত্ব না থাকায় শাসকগণ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। বিরোধী দলই সরকারের নীতি ও কর্মসূচির গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে সঠিক পথে চলতে বাধ্য করে।
৪. বিপ্লবের সম্ভাবনা : একদলীয় ব্যবস্থায় বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকে। এ ব্যবস্থায় জনগণ বহু রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় এবং সরকারের বিরোধিতা করতে পারে না। ফলে জনগণের মনে বিক্ষোভ দানা বাধতে থাকে। ফলশ্রুতিতে বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটে ।
৫. ব্যক্তিত্ব বিকাশে বিঘ্ন : একদলীয় ব্যবস্থায় ব্যক্তির সুষ্ঠু বিকাশে বিঘ্ন ঘটে। একদলীয় রাষ্ট্রে একটি নির্দিষ্ট ছকে ব্যক্তির চিন্তা- চেতনা, ধ্যান-ধারণা, কর্মকাণ্ড ইত্যাদি সব দিক নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ধরনের যান্ত্রিক পরিবেশ মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যহীন। এতে ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের স্বাধীন বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়, ব্যক্তিত্বের অপমৃত্যু ঘটে।
৬. জনমত গঠিত হয় না : একদলীয় ব্যবস্থায় সুষ্ঠু জনমত গঠিত হয় না। এতে একটিমাত্র দলই জনমত গঠনের মাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুষ্ঠু জনমত গঠনের জন্য চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা, পরমতসহিষ্ণুতা ইত্যাদি শর্ত পূরণ করা আবশ্যক। কিন্তু একদলীয় ব্যবস্থায় এ সকল শর্তের অনুপস্থিতি থাকায় সুষ্ঠু জনমত গঠিত হয় না ।
৭. রাজনৈতিক শিক্ষার সুযোগ কম : একদলীয় ব্যবস্থায় জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষার সুযোগ কম। এতে রাষ্ট্রীয় কাজে-কর্মে জনগণ উদাসীন ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। একদলীয় ব্যবস্থায় একটি দলের আদর্শ ভ্রান্ত হলেও জনগণকে তাই মেনে চলতে হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্বাধীন মতামত ও প্রচারণার অভাবে রাজনৈতিক শিক্ষার বিকাশ ঘটে না।
৮. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থের প্রতি অবহেলা একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের লোক বাস করে এবং তাদের স্বার্থও বিভিন্ন ধরনের হয়। এই বিভিন্ন ধরনের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য। তাই একদলীয় ব্যবস্থায় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ অবহেলিত হয়।