এককেন্দ্রিক সরকারের দোষ

এককেন্দ্রিক সরকারের দোষ বা অসুবিধাসমূহ বা সীমাবদ্ধতা

Demerits or Disadvantages or Limitations of Unitary Government

বিভিন্নমুখি সুবিধার পাশাপাশি এককেন্দ্রিক সরকারের বেশ কিছু ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। নিয়ে এ সকল সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটিসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা : এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় সকল ক্ষমতার উৎস হলো কেন্দ্রীয় সরকার। এতে আঞ্চলিক সরকারগুলোর কোনো স্বাধীন বা স্বতন্ত্র সত্তাকে স্বীকার করা হয় না। আঞ্চলিক সরকারগুলো কেন্দ্রিয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকে এবং কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

২. সুশাসনের প্রতিবন্ধক : এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় অভিন্ন আইনের দ্বারা সমগ্র দেশে একই শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়। কেন্দ্রিয় সরকার আঞ্চলিক সরকারগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে। যে কারণে বৃহদায়তন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এককেন্দ্রিক শাসন সুশাসনের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে ।

৩. ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণ : এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থার প্রধান ত্রুটি হলো এ ব্যবস্থায় ক্ষমতার অত্যধিক কেন্দ্রিয়করণ ঘটে। প্রাদেশিক সরকারের কোনো প্রকার কর্তৃত্বকে মান্য করা হয় না। অথচ রাষ্ট্রে সুশাসনের প্রয়োজনে এসব সরকারের গুরুত্ব কম নয়।

৪. স্বায়ত্তশাসনের অবমাননা : এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অবমাননা হয় এবং সকল বিষয়ে আঞ্চলিক সরকারগুলো কেন্দ্রিয় সরকারের উপর নির্ভরশীল থাকে। যে কারণে আঞ্চলিক সরকারের প্রতিভার যেমন প্রকাশ পায় না, তেমনি আঞ্চলিক আশা-আকাঙ্ক্ষাসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় না ।

৫. কেন্দ্রিয় সরকারের স্বেচ্ছাচার : এ ধরনের সরকারব্যবস্থায় কেন্দ্রিয় সরকার একতরফাভাবে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে। শাসনকার্যের সুবিধার্থে আঞ্চলিক সরকারের সৃষ্টি করা হলেও তাদেরকে কোনো স্বাধীনতা প্রদান করা হয় না।

৬. ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি : এককেন্দ্রিক সরকারের অন্যতম ত্রুটি হলো ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি। এ ধরনের ব্যবস্থায় কেন্দ্রিয় সরকার বিভিন্ন বিভাগের হাতে ক্ষমতার্পণ করতে নারাজ। কেন্দ্রিয় শাসনে ক্ষমতা পৃথকীকরণও সম্ভব নয়, যা গণতান্ত্রিক বিশ্বে অচল।

৭. সংখ্যালঘুদের স্বার্থ উপেক্ষিত : রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘু লোক থাকতে পারে। কিন্তু এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় এসকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় না। ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এ ধরনের ক্ষোভ বিপ্লব ডেকে আনতে পারে ।

৮. রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ রুদ্ধ : এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের কোনো প্রকার সুযোগ নেই বললেই চলে। ফলে দেশের রাজনৈতিক ব্যাপারে জনগণের মধ্যে এক প্রকার অনীহা ভাব পরিলক্ষিত হয়। আর এতে করে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে না।

৯. স্বৈরাচারের আশঙ্কা অনেক সমালোচক মনে করেন, এককেন্দ্রিক শাসন পদ্ধতিতে স্বৈরাচারের আশঙ্কা থাকে। কারণ এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা অতিমাত্রায় কেন্দ্রিভূত হয়। ফলে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতালিপু হয়ে স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করতে পারে।

১০. আমলাতান্ত্রিক জটিলতা : আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার একটি বড় রুটি। কেন্দ্রিয় সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালিত হয় বিধায় সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে শাসনব্যবস্থা হয়ে ওঠ আমলানির্ভর। এতে সরকারি কর্মচারীদের দৌরাত্মা বৃদ্ধি পায়।

১১. অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখল : এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় অনেকগুলো কর্তৃপক্ষের মধ্যে নির্বাহী ক্ষমতা বণ্টন করা হয় না বিধায় বাইরের কিংবা ভেতরের যে কোনো শক্তি সহজেই ক্ষমতা দখল করতে পারে।

১২. নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে না : এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম স্বল্প পরিসরে থাকে এবং রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগও কম থাকে। যে কারণে নেতৃত্ব বিকাশের সুবিধা সম্প্রসারিত হয় না এবং শাসনব্যবস্থায় সুনেতৃত্বের বিকাশ লাভ ঘটে না। ফলে জনসাধারণ অধিক পরিমাণে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে না পারায় রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটে না ।

১৩. বৃহৎ রাষ্ট্রের জন্য উপযোগী নয় : বর্তমানে রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। উপরন্তু বর্তমান রাষ্ট্র জনকল্যাণমুখি রাষ্ট্র। এ কারণেও রাষ্ট্রের কার্যাবলি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু একক এবং একটিমাত্র কেন্দ্রিয় সরকারের পক্ষে ব্যাপক ও বহুমুখি কার্যাবলি সম্পাদন করা অসম্ভব। যে কারণে এ ধরনের সরকারব্যবস্থা বৃহৎ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বলে অনেকে মনে করেন। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ার ন্যায় বৃহদায়তন রাষ্ট্রের জন্য এ ধরনের শাসনব্যবস্থা উপযোগী নয় ।

১৪. বিচ্ছিন্নতাবাদ বিপ্লবের আশঙ্কা : এককেন্দ্রিক শাসনে বিভিন্ন রাজ্যের দাবি-দাওয়া, সংখ্যালঘুদের স্বার্থ উপেক্ষা এবং একতরফাভাবে কেন্দ্রের ক্ষমতা প্রয়োগ প্রভৃতিতে বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দেয়। দেশে এ ধরনের আঞ্চলিকতা, প্রাদেশিকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও ক্রমপুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে কালক্রমে জনগণ বা সেনাবাহিনী বিপ্লবের ডাক দিতে পারে।

১৫. আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট : কোনো একটি রাষ্ট্রে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন স্থানে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিরাজ করে। কিন্তু কেন্দ্রিয় সরকার কর্তৃক অভিন্ন নীতি, আইন বা বিধান প্রয়োগ করায় সেসব স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য বিনাশ হতে পারে।

১৬. ব্যক্তি স্বাধীনতা বিপন্ন : এককন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় সংবিধানের নমনীয়তা এবং বিচার বিভাগের দুর্বলতার কারণে ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে।

১৭. দলীয় স্বেচ্ছাচার : এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় কোনো সরকার ক্ষমতায় গেলে সে সরকারের দল ও তাদের স্বার্থ, মতামত ও সিদ্ধান্ত বড় করে দেখা দেয় এবং আইন, বিচার ও শাসনকার্য সেভাবেই পরিচালিত হয়। এমনকি কেন্দ্রের শাসন ও সিদ্ধান্ত প্রয়োগসহ অনেকক্ষেত্রে দলীয় আদর্শ ও নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সংবিধানও পরিবর্তন করা হয়। ফলে অবাধ দলীয় স্বেচ্ছাচার ও একনায়কতন্ত্র জন্ম নেয়।

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় এমন কতগুলো ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান যার ফলে জনগণ বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হয়। সরকারের হাতে অবাধ ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত হয়, দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়। লর্ড অ্যাকটনের (Lord Acton) ভাষায়, “Power corrupts and absolute power corrupts absolutely.” তবে গণতান্ত্রিক আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে এ সকল ত্রুটি দূর করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের কথা বলা যায়। যেখানে এককেন্দ্রিক সরকার কাঠামোর আওতায় সবচেয়ে জনপ্রিয় ও নন্দিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। আবার ভৌগোলিক ও জাতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ কিন্তু রাজনৈতিকভাবে অনিচ্ছুক জনবসতিসম্পন্ন ক্ষুদ্রায়তন রাষ্ট্রে এ সরকার সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে। আবার বৃহৎ আয়তন এবং বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীসম্পন্ন প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় রাষ্ট্রে এককেন্দ্রিক সরকার নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার সাফল্য লাভ করতে পারে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কথা বলা যায়।

Leave a Reply