Table of Contents
Toggleউত্তম সংবিধান বা শাসনতন্ত্র Good Constitution
সকল সংবিধান উত্তম সংবিধান নয়। কোনো সংবিধানকে উত্তম সংবিধান হতে হলে তাতে বিশেষ গুণের সমন্বয় থাকা আবশ্যক। উত্তম সংবিধানের কতিপয় সংজ্ঞা তুলে ধরা হলো :
১. উইলোবী (Willoughby)-এর মতে, “উত্তম সংবিধান হলো আইন ও সংবিধানের বিধিবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও কার্যকর সংবিধান।” ২. লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce)-এর ভাষায়, “Ideally best form of constitution refers aggregate of best qualities and ideologies.”
৩. অগ (Ogg)-এর মতে, “আদর্শ সংবিধান হচ্ছে মৌলিক আইন দ্বারা পরিবেষ্টিত ও স্থিরকৃত সংবিধান।”
৪. কে. সি. হুইয়ার (K. C. Wheare)-এর ভাষায়, “One essentially charactresitics of the ideally best form of constitution is that should be as short as possible.”
সুতরাং বলা যায় যে, উত্তম সংবিধান হলো বিশেষ গুণাবলির সমন্বয়ে গঠিত সংবিধান, যা সাধারণ আইন ও সাংবিধানিক আইনের দ্বারা বেষ্টিত। উত্তম সংবিধান গণতান্ত্রিক গুণাবলির সাথে সম্পৃক্ত। বর্তমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে উত্তম সংবিধানের কদর দিন দিন বাড়ছে।
উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য Characteristics of Good Constitution
উত্তম সংবিধান যে কোনো দেশ, জাতি বা রাষ্ট্রের জন্য একান্ত কাম্য। কারণ এর মাধ্যমে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা আনয়ন এবং উন্নয়ন সাধন সম্ভব হয়। কিন্তু উত্তম সংবিধান প্রতিষ্ঠার কাজটি সহজসাধ্য নয়। তাই উত্তম সংবিধান প্রণয়নের জন্য কিছু শর্ত পূরণ বা বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। নিম্নে উত্তম সংবিধানের প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. লিখিত রূপ : উত্তম সংবিধানের একটি আকর্ষণীয় এবং অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হলো এর লিখিত রূপ। উত্তম সংবিধানের অধিকাংশ বিধি-বিধান লিখিত আকারে থাকবে। এতে করে সংবিধানের কোনো বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা দূর হয় এবং সাংবিধানিক বিতর্কের অবসান ঘটে। পৃথিবীর প্রায় সকল রাষ্ট্রের সংবিধানই কম-বেশি লিখিত ।
২. মুখবন্ধ বা প্রস্তাবনা : উত্তম সংবিধানের শুরুতে একটি সুন্দর প্রস্তাবনা বা ভূমিকা থাকবে। ভূমিকায় সাধারণত দেশ ও জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার পূর্বাভাস থাকে এবং বাস্তবায়নের দিক নির্দেশনাও উল্লেখ থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের শুরুতে একটি প্রস্তাবনা সংযোজিত হয়েছে এভাবে, “We are the people of the united states.” বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ আছে, “আমরা বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া…….।” সংবিধানের প্রস্তাবনা সম্পর্কে কে.সি. হুইয়ার (K. C. Wheare ) বলেন, “It is not permissible but desirable.”
৩. সংক্ষিপ্ত রূপ : সংবিধান যত সংক্ষিপ্ত হবে তত ভালো। এর বিধিবিধান যথাসম্ভব সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণিত হওয়া উচিত। সেই সাথে অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিকতা পরিহার করে সংবিধানকে বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করা উচিত। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান খুবই সংক্ষিপ্ত। এর শব্দ সংখ্যা মাত্র ৫/৬ হাজার, মাত্র ৭/৮ মিনিটে এটি পাঠ করা যায়।
৪. স্থায়িত্ব : স্থায়িত্ব উত্তম সংবিধানের একটি বিশেষ দিক। সংবিধান ভাবাবেগে উত্তেজনাবশত সংশোধন করা যায় না। সংবিধান স্থায়ী না হলে তাতে যত্রতত্র পরিবর্তন ও সংশোধন গৃহীত হয়। ফলে শাসন পরিচালনায় সমস্যা দেখা দেয়। ৫. সীমিত দুষ্পরিবর্তনীয় প্রকৃতি : সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তম সংবিধান কিছুটা দুষ্পরিবর্তনীয় প্রকৃতির হওয়া বাঞ্ছনীয়। সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতি অত্যন্ত সহজসাধ্য হলে সংবিধানের স্থিতিশীলতা ও মর্যাদা হ্রাস পায়। আবার সম্পূর্ণ বা কঠোরভাবে দুষ্পরিবর্তনীয় হলে পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না ।
৬. রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও মূলনীতির উল্লেখ : রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি একটি সংবিধানকে বিশিষ্ট করে তোলে।ফলে কোনো একটি সংবিধানকে উত্তম সংবিধান হতে হলে এসবের উল্লেখ থাকতে হবে।
৭. মৌলিক দলিল : সংবিধান রাষ্ট্রের মৌলিক দলিল হিসেবে বিবেচিত। কোনো আইন, প্রথা বা শাসন বিভাগীয় নির্দেশ সংবিধানের পরিপন্থী হতে পারে না; বরং আইনসভা সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করে। সংবিধান জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। সংবিধান সরকারের ক্ষমতার সীমা নির্দেশ করে। এ প্রসঙ্গে কে.সি. হুইয়ার (K. C. Wheare) বলেন, “Constitution springs from a belief in limited Government.” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা হয়েছে, “এ সংবিধান, সংবিধানের শর্তসাপেক্ষে রচিত আইন এবং চুক্তি হতে উদ্ভূত আইনই হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন।”
৮. মৌলিক অধিকারের উল্লেখ : উত্তম সংবিধানে মৌলিক অধিকারের উপস্থিতি থাকতে হবে। কেননা, জনগণের অধিকারকে কোনোভাবে খর্ব করা চলে না। অধিকার সুস্পষ্ট ও লিপিবদ্ধ হলে কেউ খর্ব করতে পারে না। যেমন— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে মার্কিন নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানেও মৌলিক অধিকারের উল্লেখ রয়েছে।
৯. সংবিধানের প্রাধান্য : সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দলিল। যে কারণে রাষ্ট্রের যে কোনো বিষয়ে সংবিধান যাতে সর্বশীর্ষে স্থান পায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। রাষ্ট্রের সকল ব্যক্তি, বিভাগ, সংস্থা সংবিধানের অধীন। সংবিধান পরিপন্থী যে কোনো আইন বাতিল বলে গণ্য হবে। কোনো কোনো দেশে সংবিধান সর্বোচ্চ আইন হিসেবে গণ্য হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ১৮০৩ সালে Murvery vs Madision-এর মামলার রায়ে সংবিধানের প্রাধান্য প্রশ্নে বলেন, “নিশ্চয় যারা লিখিত সংবিধান প্রণয়ন করেছেন তারা মনে করেন যে, তারা সংবিধানকে জাতির মৌলিক বা সর্বোচ্চ আইন হিসেব প্রণয়ন করেছেন।”
১০. বহুদলীয় ব্যবস্থা : বর্তমানে গণতন্ত্র বলতে বহুদলীয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রকে বুঝায়। এ ধরনের ব্যবস্থায় সংবিধান উত্তম হওয়া উচিত। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সংক্ষিপ্ত এবং সুস্পষ্ট কিন্তু সেখানেও বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। আমাদের বাংলাদেশেও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। উত্তম সংবিধানের এটা একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
১১. বিচার বিভাগের প্রাধান্য : উত্তম সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে বিধান থাকতে হবে। বিচারকগণ যদি স্বাধীনভাবে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে না পারে তাহলে সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান মূলত ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতির আলোকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের বিধান করে।
১২. শাসন বিভাগের দায়িত্ব নির্দিষ্টকরণ : ক্ষমতার যাতে করে অপব্যবহার না হয় সেজন্য উত্তম সংবিধানে শাসন বিভাগের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। কারণ শাসন বিভাগ কোনো সুযোগ পেলেই তার এখতিয়ারের বাইরে কাজ করার চেষ্টা করে।
১৩. আইন বিভাগ কর্তৃত্ব নির্ধারণ : আইন বিভাগ রাষ্ট্রের সংবিধানকে আইন প্রণয়নের মৌলিক সূত্র হিসেবে ধরে আইন প্রণয় করবে। সংবিধান পরিপন্থী কোনো আইন যাতে করে আইন বিভাগ প্রণয়ন করতে না পারে সে বিষয়ে সংবিধানে উল্লেখ থাকতে হবে।
১৪. সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্য : রাজনৈতিক সার্বভৌমের সাথে আইনগত সার্বভৌমের বিরোধ চলতে পারে না। যে কারণে উত্তম সংবিধানে উভয়ের অবস্থান, এখতিয়ার ও কার্যপ্রণালির মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে।
১৫. আইনের শাসন : উত্তম সংবিধানের আরো একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো আইনের শাসনের উল্লেখ। আইনের শাসনের মূল কথা হলো আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান, আইন সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কোনো আইন কোনো ব্যক্তি বিশেষের প্রতি কোনরূপ পক্ষপাতিত্ব করবে না। বিনা কারণে কাউকে আটক করা যাবে না এবং বিনা বিচারে কাউে আটক রাখা যাবে না। উত্তম সংবিধানে আইনের শাসনের এ দিকগুলোর উল্লেখ থাকবে।
১৬. ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ : সংবিধানে ক্ষমতার পৃথকীকরণ (Separation of power) নীতির উল্লেখ থাকা উচিত। কেননা, ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি গণতন্ত্রের একটি মৌলিক দিক। ক্ষমতার পৃথকীকরণ থাকলে সরকারের প্রতিটি বিভাগ তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকে। এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে না ।
১৭, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন : রাষ্ট্রের সংবিধান মূলত জনগণের জন্য। রাষ্ট্রের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা। তাই সংবিধান রচনার সময় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
১৮. সংহতির দলিল : এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় উভয় ব্যবস্থায়ই সংবিধান রাষ্ট্রের সংহতির দলিলস্বরূপ। যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির উল্লেখ থাকে। রাষ্ট্রের মধ্যে উপস্থিত বিভিন্ন শ্রেণি ও স্বার্থগোষ্ঠীর স্বার্থকে গ্রন্থিবন্ধনের সুব্যবস্থা থাকে এমন নিশ্চয়তা উত্তম সংবিধানে বিদ্যমান থাকে ।
১৯. ভাষার সরলীকরণ : উত্তম সংবিধানের একটি বিশেষ গুণ হলো ভাষার সরলীকরণ। এ সংবিধানে ভাষার প্রাঞ্জলতা থাকা আবশ্যক। কেননা, ভাষা খুব কঠিন হলে জনগণ তা বুঝতে পারে না। যে কারণে সংবিধানে কঠিন ও দুর্বোধ্য ভাষা পরিহার করা উচিত।
২০. বিশ্বশান্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ : আঞ্চলিক সুসম্পর্ক স্থাপনের পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক শান্তি ও সম্প্রীতি কামনা করছে। ফলে বিশ্বশান্তির জন্য পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত বিষয় উত্তম সংবিধানে স্থান দিতে হবে।
সংবিধান মূলত জনগণের জন্য। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সিভিল সমাজের প্রয়োজনে সংবিধান উপহার দিয়ে থাকে। তাই এখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনগণের সংবিধান প্রতিপালনের যোগ্যতা, সদিচ্ছা এবং অনুকূল পরিবেশ। সর্বোপরি উল্লিখিত গুণাবলির পাশাপাশি যদি কোনো দেশের সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পায়, তবেই সেদেশের সংবিধান উত্তম সংবিধান হিসেবে পরিগণিত হবে ।