Table of Contents
Toggleবিচার বিভাগের জবাবদিহিতা Judicial Responsibility
বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা Judicial Responsibility
বিচারক বা আদালত সম্পর্কে বিনা প্রমাণে কটাক্ষ করে বক্তব্য প্রদান করলে তা আদালত অবমাননাকর হবে এবং সেজন্য নির্দিষ্ট শাস্তির বিধান আছে। অনেকে মনে করেন, আদালত ও বিচার সম্পর্কে কথা বললে বা লিখলে আদালত অবমাননা হবে, কিন্তু তা সর্বদা ঠিক নয়। কোনো ব্যক্তি সরল বিশ্বাসে কোনো আদালতের রায় বা বিচারকের সমালোচনা করলে তিনি তা ভুল করেননি বলে ধরতে হবে। অসৎ উদ্দেশ্যে কিংবা ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্য ব্যতীত যদি কেউ যৌক্তিকভাবে আদালতের রায় বা বিচারকের সমালোচনা করেন তবে তা অনুমোদিত। বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ সলিমুল্লাহ বনাম 44DLR(AD)309 মামলায় বলেছেন, “আমাদের সংবিধান যেহেতু সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেহেতু সমালোচনা সহ্য করতে হবে। একমাত্র অসৎ উদ্দেশ্যের মতো ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রেই কেবল আদালত অবমাননা আইনের আশ্রয় নিবেন।” বিচারক সত্যিসত্যিই অপরাধ করলে বা আইনের পরিপন্থী কিছু করে থাকলে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তার বিচার হতে পারে। ভারতের সংবিধানে বলা আছে যে, সুপ্রিমকোর্ট বা হাইকোর্টের বিচারক সম্পর্কে সংসদে সাধারণ আলোচনা করা যাবে না। সেখানে আলোচনা হতে পারে অভিশংসনের ব্যাপারে। বাংলাদেশ সংবিধানেও এ বিষয়ে উল্লেখ আছে। সুতরাং সমালোচনার ক্ষেত্রে আইনগত দিকের প্রতি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে ।
বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা দেশের সব মানুষই জানেন। শুধুমাত্র দেশের নন, বিদেশিরাও এ বিষয়ে অবগত আছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা শাসন বিভাগের কাজ। শাসন বিভাগের বা সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই এর জন্য দায়ী। সুতরাং তিনি উৎকণ্ঠা প্রদর্শন করতে পারেন। বিষয়টি রাজনৈতিক নয়, বরং বলা যায় এটি তার সাংবিধানিক দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সাথে যারাই জড়িত আছেন তাদের তিনি সাবধান করতে বা পরামর্শ দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পূর্বেকার শাসনমালে (১৯৯৬ ইং হতে ২০০১) দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে বলেছিলেন, দেশে খুনীদের রক্ষা করা হয়-সহযোগিতা করা হয়। যে দেশে খুনীদের বিচার হয় না সেদেশে হত্যা চলবেই। সমস্যা হচ্ছে পুলিশ কষ্ট করে আসামিদের ধরে, কিন্তু সাথে সাথে আদালত হতে জামিন দেয়া হয়। আদালত হচ্ছে অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে এসেই আবার হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। তাঁর মতে, যে উকিল জামিন চান তাকেও ধরা উচিত এবং যে কোর্ট জামিন দেয় সে কোর্টের জবাবদিহি করা দরকার।
[অনিরুদ্ধের কলাম, “ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক নিবেদন” সংবাদ ১৮.০৮.২০০০] –
প্রধানমন্ত্রী দেশের এক বাস্তব অবস্থার কথা জনগণের সামনে তুলে ধরেন। কথাটিতে আদালত ও আইনজীবীদের কটাক্ষ করা হয়েছে সত্য, কিন্তু তা অবাস্তব ও কল্পনাবিলাসী নয়। তাঁর এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের না হলেও আইনজীবীদের এক অংশের মধ্যে তোলপাড় আরম্ভ হয়। তাদের কথায়, প্রধানমন্ত্রী আদালত অবমাননাকর কথা বলেছেন, তাই তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া কর্তব্য। সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েসনের তৎকালীন সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করেন। উচ্চ আদালত ও আইনজীবীদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করায় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বিরোধীদলের সদস্যরাও একযোগে এ বিষয়ে মামলা করেন।
বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা Judicial Responsibility
বিচার বিভাগ হলো সবচেয়ে সম্মানী শাখা। বিচার বিভাগ যাতে স্বাধীন ও নিরপক্ষে থেকে কাজ করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। বিচার বিভাগ কর্তৃক প্রদেয় বিচারের রায় আমাদেরকে মান্য করতে হয়। এখন প্রশ্ন হলো বিচারকগণ তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করবে কি-না? অবশ্যই বিচারকগণ তাদের কাজের জন্য দায়বদ্ধ থাকবেন। কেননা, কোনো মানুষই দায়িত্বশীলতার ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না। বিচারকগণও তাদের কাজের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমের কাছে জবাবদিহি করবেন। তবে তারা যেহেতু সহজে প্রতিবাদ করতে পারেন না তাই বিচারক সম্পর্কে কিছু বলার ক্ষেত্রেও অবশ্যই বাধ্যবাধকতা আরোপিত থাকা বাঞ্ছনীয়। অন্য কোনো বিভাগ বা ব্যক্তিগতভাবে কারো বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলা হলে সে বিভাগ বা ঐ ব্যক্তি এর জন্য সভা-সমাবেশ করতে বা পত্রিকায় বিবৃতি দিতে পারেন, অথচ বিচার বিভাগের এরকম করার ক্ষেত্র বড় সীমিত। এ বিষয়ের উপর নিম্নে আলোকপাত করা হলো ।
সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে আইনসভার জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয় আইনসভার মাধ্যমেই। আইনসভা এমন কোনো আইন পাস করতে পারেন না যা সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। এসব ক্ষেত্রে বিরোধী দল, বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী, ছাত্র- জনতা-সকলেই তার প্রতিবাদ করতে পারে। পার্লামেন্টের অভ্যন্তরেও বিপুল সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। এরশাদ সরকারের সময় ১৯৮৯ সালে জেলা পরিষদে সামরিক বাহিনীর লোক নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলে সর্বস্তরে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অবশেষে সরকার বাধ্য হয়ে বিলটি প্রত্যাহার করে। আইনসভা মূলত এভাবেই জবাবদিহি করে থাকে । সংসদীয় সরকারের শাসন বিভাগ আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকে। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, মূলতবি প্রস্তাব আনয়ন, অভিসংশন ইত্যাদির দ্বারা আইনসভা শাসন বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হয়। অন্য মাধ্যমগুলোও শাসন বিভাগের জনবিরোধী কাজের তীব্র সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু বিচার বিভাগের জবাবদিহিতা একটু ভিন্ন প্রকৃতির। বিচার বিভাগের কাজের সমালোচনা ঠিক আইন ও শাসন বিভাগের মতো হয় না। দুটি বিভাগের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক জড়িত থাকলেও বিচার বিভাগের সাথে এর কোনো সংশ্রব থাকতে পারে না। এজন্য রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা করা যায় না এবং তার ভিত্তিতে জবাবদিহিতাও আদায় করা যাবে না। তাহলে কি বিচার বিভাগের কোনো জবাবদিহিতা থাকবে না? উত্তর হবে -অবশ্যই থাকবে ।
ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিতাম্বরমের কথায়, অন্য মানুষের মতো বিচারক যদি ভুল করেন তাহলে সরকারের মতো তাদেরও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকা উচিত। এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় কথা হলো, “একজন যত বড়ই হোক আইন তার উপরে। সভ্য সমাজে বেঁচে থাকতে হলে এমন বিচারব্যবস্থা দরকার যার জবাবদিহিতা হবে সর্বোচ্চ। বিচারকগণ যে কারো কাছে জবাবদিহি নয় সে ধারণা মানুষের মধ্যে থেকে দূর করতে হবে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এর একটি লেখা থেকে জানা যায় যে, বিলেতে বিচারকদের ভয়ঙ্কর সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। ১৯৯৮ সালের ১ নভেম্বর সানডে টাইমসে ৪ জন বিচারক সম্পর্কে সমালোচনা করা হয়। ৪ জন বিচারক সম্পর্কে জনগণ যে মতামত প্রদান করে তাতে বুঝা যায় যে, তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন নি। বিলেতের জনগণ ও আইনজ্ঞদের মতে, বিচারকদের সমালোচনা করা কোনো আদালত অবমাননা নয়। মামলার বিচার করার অধিকার যেমন বিচারপতিদের রয়েছে, তেমনি বিচারপতির বিচার করার ক্ষমতা আছে জনগণের। এটা তাদের মৌলিক অধিকার। যে চারজন বিচারপতির সমালোচনা করা হয়েছে তারা জনগণের রায়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে যথাক্রমে ৪৭, ৪৬, ৩৫ ও ৩২ নম্বর পান ৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বার এসোসিয়েশন নিয়মিত বিচারপতিদের মূল্যায়ন করে। ন্যায়পরায়ণতা ও জবাবদিহিতা পাশাপাশি জড়িত। কেননা, ন্যায়পরায়ণতা নিজের বিবেককে তুষ্ট রাখে, আর জবাবদিহিতা জনগণের কাছে ন্যায়পরায়ণতাকে প্রতিষ্ঠিত করে। সুপ্রিমকোর্টের কোনো রায় বা হুকুম নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা যে কেউ করতে পারে। আইনের ব্যাখ্যায় ভুল থাকলেও তা সমালোচিত হতে পারে। ভারতের সুপিকোর্ট শাহবানু মামলায় সে রায় দেন তা কঠোরভাবে সমালোচিত হয়। সুপ্রীমকোর্টে একবার রায় দেয়া হয়ে গেলে তার উপর আর বিচারকের বা সুপ্রিমকোর্টের কোনো বিশেষ স্বত্ব থাকে না। রায়টি তখন জনসাধারণের বিষয় হয়ে যায়। সে কারণে তার আলোচনা বা সমালোচনা করতে পারে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীও বিচারকদের উপর নাখোশ হয়েছেন ।
অন্যদিকে ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলামের নেতৃত্বে ৫৫০ জন আইনজীবী এক বিবৃতিতে বলেছেন, খুনের আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে এসে তাদের গডফাদারদের আশ্রয়ে থেকে আবারও হত্যা ও সন্ত্রাস সৃষ্টিতে সমাজে অপরাধ করছে। তারা সাক্ষীদের মুখ বন্ধ এবং আইনের প্রয়োগ অকার্যকর করে ফেলছে, তারা নতুন করে খুন ও রাহাজানি করছে এবং এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তা দেশবাসীর উদ্বেগেরই বহিঃপ্রকাশ। অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও তাঁর এ কথাকে যথার্থ সমর্থন করেছেন।
অবশেষে আদালত অবমাননা মামলার শুনানি শুরু হয়। রাষ্ট্রের প্রতিনিধি এটর্নী জেনারেল মাহমুদুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কথা বলেন। তাঁর মতে, প্রধানমন্ত্রীর এধরনের মন্তব্য আদালত অবমাননার শামিল নয়। এর পিছনে কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, যার দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট বিচারককে আক্রমণ করা হয়েছে। তিনি সাধারণ মানুষের বাকশক্তি ও মৌলিক অধিকারের কথা বলেছিলেন। অন্যদিকে আবেদনকারীদের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করা হয় যে, তিনি আদালত ও আইনের শাসনের পরিপন্থী মন্তব্য করেছেন। পূর্ণ আদালত ভবনে এটর্নী জেনারেল বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী সুপ্রিমকোর্টের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বিচারব্যবস্থার দুরবস্থার কথা ব্যক্ত করেন, কিন্তু সেখানে আদালত অবমাননার আবেদন করা হয়নি। মাননীয় আদালতকে উদ্দেশ্য করে তিনি আবার বলেন যে, গতকল্য মাত্র দুই জন আইনজীবী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এসব অবস্থার কথাই ব্যক্ত করেছেন। তিনি এ দৃশ্যপটে মামলাটি খারিজ করার আবেদন জানান। হাইকোর্ট ২৪ অক্টোবর, ২০০০ তারিখে তিনটি আবেদনই খারিজ করেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে এসব ব্যাপারে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বনের কথা বলা হয়। উক্ত বেঞ্চ গঠিত হয় বিচারপতি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ এর নেতৃত্বে।