আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস ও শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণসমূহ
Causes of decreasing the Power of the Legislature and Increasing the Power of the Executive
বর্তমান সময়ে আধুনিক সরকার ব্যবস্থার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা হলো শাসন বিভাগের ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি বিপরীতে আইনসভার ক্ষমতার হ্রাস। যদিও ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত আইনসভা অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে সকল ধরনের সরকার ব্যবস্থায় আইনসভার ভূমিকা হ্রাস পেয়ে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের পীঠস্থান ব্রিটেনে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে অনেকেই ক্যাবিনেটের একনায়কতন্ত্রের (Cabinet Dictatorship) অভিযোগ এনেছেন। তাছাড়া বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশে সামরিক ও একনায়কতান্ত্রিক শাসন কায়েম হওয়ায় সেখানে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ, দু’একটি ব্যতিক্রম ব্যতীত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধির পশ্চাতে কতগুলো কারণ ক্রিয়াশীল :
১. জনকল্যাণমূলক কাজের সম্প্রসারণ : সাম্প্রতিককালে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনকল্যাণমূলক কাজের সম্প্রসারণের ফলে’ শাসন বিভাগের দায়িত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরূপ সেবামূলক কর্মকাণ্ডের দায়িত্বের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে আইনসভা ক্রমবর্ধমান দায়িত্ব পালন করতে পারে না। যে কারণে শাসন বিভাগকেই এ সকল কাজের দায়িত্ব পালনের জন্য এগিয়ে আসতে হয়। তাছাড়া, সংসদীয় পদ্ধতিতে শাসন বিভাগই সরকারি নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করে থাকে। এর ফলে শাসন বিভাগের সাথে জনসাধারণের ব্যক্তিগত ও দৈনন্দিন জীবনের গভীর সংযোগ সাধিত হয়। এভাবে সরকারি কর্মকাণ্ডে আইনসভা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং এই সুযোগে শাসন বিভাগ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে ।
২. শাসন বিভাগের নেতৃত্ব : শাসন বিভাগ, আধুনিক সরকারের নেতৃত্ব প্রদান করে। শাসন বিভাগে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীগণ থাকেন, যারা সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করে থাকেন। আইন বিভাগ ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ স্বাভাবিকভাবেই শাসন বিভাগের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলবৎ থাকায় কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণমুক্ত। তথাপি রাষ্ট্রপতিই সে দেশের জাতীয় সরকারের নেতৃত্ব প্রদান করে থাকে। এসকল কারণ ও অবস্থা শাসন বিভাগের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে।
J
৩. শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে সমস্যা : আধুনিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলি বৃদ্ধি পাওয়ায় আইনসভা শাসনবিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বর্তমানে আর গতানুগতিক পদ্ধতিতে শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্ৰণ করা সম্ভব হয় না। কারণ শাসন বিভাগ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সাম্প্রতিক তথ্য ‘আইনসভার নিকট নেই। ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে।
.
৪. শাসন বিভাগের উপর জনগণের আস্থা : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে জনগণ এখন আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের কাজের মধ্যে তুলনামূলক বিচার করতে সক্ষম হচ্ছে। আইন প্রণয়নে দুর্বল সদস্যদের তুলনায় শাসন বিভাগের দক্ষ ব্যক্তিবর্গ নিজেদের যোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করছে। শাসন বিভাগ প্রশাসনে প্রত্যক্ষ কার্যকারক হওয়ায় জনগণের সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং জনগণ শাসন বিভাগের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে আইনসভার সদস্যগণ ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
২০. জনমত গঠনে ব্যর্থতা : জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার এবং জনমত সংগঠনের ক্ষেত্রে আইনসভার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানকালে আইনসভা এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম তথা বেতার, দূরদর্শন, সংবাদপত্র প্রভৃতি মাধ্যমগুলো জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যে কারণে আইনসভার মর্যাদাহানি ঘটে।
২১. চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর গুরুত্ব : রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সমাজে অনেক চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়, যারা শ্রেণি স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। অন্য কথায় বলা যায়, সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করার এবং সরকারের সাথে জনসাধারণের সংযোগ সাধনের মাধ্যম হিসেবে এ ধরনের গোষ্ঠীসমূহের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বৃদ্ধি গেয়েছে। যদিও তত্ত্বগতভাবে আইনসভাই সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করার কথা। কিন্তু বর্তমানে চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী সরাসরি সরকারের সাথে সংযোগ রক্ষা করছে বিধায় আইনসভার গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে। ২২. আইনসভার গণসংযোগের অভাব : উদারনৈতিক শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগই নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে থাকে। এ সূত্রে শাসন বিভাগ নানাভাবে জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ ও অভাব-অভিযোগের সাথে সম্পৃক্ত হয়। কিন্তু আইন বিভাগের এক্ষেত্রে করণীয় কিছুই নেই। এর ফলে শাসন বিভাগের উপর জনগণের আস্থা ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পায়। সেই সাথে আইনসভার গুরুত্ব হ্রাস পায় ।
২৩. যুদ্ধ বা যুদ্ধভীতি : যুদ্ধ বা যুদ্ধভীতি শাসন বিভাগের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে। যুদ্ধের সময় যুদ্ধ পরিচালনা বা সেনা পরিচালনার জন্য শাসন বিভাগের হাতে প্রচুর ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। এতে করে যুদ্ধকালীন সময়ে শাসন বিভাগের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। উপরন্তু রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। যে কারণে যুদ্ধকালীন সময়ে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় এবং আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পায়। ২৪. সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ : তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করছে। ফলে নির্বাচিত আইনসভার ভূমিকা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। কারণ সামরিক বাহিনী ইচ্ছেমতো দেশ পরিচালনা করে। সেখানে নির্বাচিত আইনসভার কোনো ভূমিকা থাকে না।
২৫. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি : জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিরাজমান পরিস্থিতি শাসন বিভাগের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে আইন বিভাগের ক্ষমতাকে হ্রাস করছে। কেননা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে মোকাবিলার জন্য শাসন বিভাগই নীতি নির্ধারণ, আইন প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আইনসভা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শাসন বিভাগের এই প্রাধান্যকে স্বীকার করে নেয়। যে কারণে ব্রিটিশ সরকারকে প্রধানমন্ত্রীর সরকার বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নীতি প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসকে পরিণত হয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদের রাষ্ট্রপতিকরণ সাধিত হয়েছে বলে অনেকে
মনে করেন।
২৬. জনগণের মনস্তত্ত্ব : জনগণের মানসিকতা শাসন । গের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে আইন বিভাগের ক্ষমতাকে হ্রাস করছে। কেননা, আধুনিক রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যাবলি শাসন বিভাগই পরিচালনা করে। যে কারণে জনগণের দৃষ্টি শাসন বিভাগের উপর পড়ে এবং জনগণ শাসন বিভাগকে তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিভূ বলে গণ্য করে। জনগণের এ ধরনের মানসিকতা আইন বিভাগের ক্ষমতাকে হ্রাস করছে।
২৭. দারিদ্র্যতা : অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যতা মোচনের জন্য সরকারের শাসন বিভাগকেই দাতা দেশগুলোর নিকট হাত পাততে হয় বিধায় শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২৮. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি : আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও বিশ্বায়নের ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নির্বাহী প্রধান উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সরাসরি নির্বাচকমণ্ডলীর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে নিজের আদর্শ ও কর্মসূচি সম্পর্কে গণআস্থা সৃষ্টি করেন। এ কাজে নির্বাহী বিভাগ যতটা দক্ষ অন্যান্য বিভাগ ততটা দক্ষ নয়। তাছাড়া বহির্বিশ্বের সাথে শাসন বিভাগ দ্রুত যোগাযোগ রক্ষা করে নিজের ও দেশের ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন। এটা অন্যান্য বিভাগ থেকে শাসন বিভাগকে শক্তিশালী করেছে।